আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
আমেরিকা ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করতেই নড়েচড়ে বসেছে নয়াদিল্লি। কী ভাবে বাণিজ্য নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা করা যায়, কী কী শুল্কছাড়ের প্রস্তাব দিলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মানভঞ্জন’ হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামী ২৫ অগস্ট আমেরিকার একটি প্রতিনিধিদল ভারতে আসবে। সূত্রের খবর, বাণিজ্যচুক্তির জন্য তাদের কী কী প্রস্তাব দেওয়া যায়, তা দেখতে বলা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রককে। চলতি মাসে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে ইতিবাচক আলোচনায় আগ্রহী নয়াদিল্লি।
ভারতের পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন, রাশিয়া থেকে খনিজ তেল এবং অস্ত্র আমদানির জন্য ভারতকে ‘জরিমানা’ দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প হতাশ এবং বিরক্ত, দাবি করেছেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো। মূলত ভারতের বাজারে প্রবেশপথ আরও অবাধ করতে চেয়েছে আমেরিকা। আরও সহজে ভারতের বাজার যাতে ব্যবহার করতে পারে মার্কিন সংস্থাগুলি, সেই ব্যবস্থা করে দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত ভারত যা যা পদক্ষেপ করেছে, তাতে আমেরিকা সন্তুষ্ট নয়। ভারতের তরফে একাধিক ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হয়েছে। বাণিজ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর কেন্দ্রের অর্থ সংক্রান্ত মন্ত্রকগুলিও নিজ নিজ এক্তিয়ারে থেকে শুল্ক ছাড় দিতে শুরু করেছে। কিন্তু জটিলতা এখনও কাটেনি।
কয়েকটি সূত্রে দাবি, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি রাশিয়ার তেল আমদানি কমাতে শুরু করেছে। সূত্র উল্লেখ করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, যে যে শুল্কছাড়ের কথা ভাবা হচ্ছে, তা যদি সঠিক ভাবে অনুসরণ করা যায়, তবে তা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা এ-ও মনে করছেন, ট্রাম্পের মন্তব্যগুলির বিরোধিতা করে ভারত থেকে মাঝেমধ্যে যে সমস্ত কড়া বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা অপ্রয়োজনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলি এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যে সমস্ত দেশের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের প্রত্যাশা ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের, সেই তালিকায় প্রথম সারিতে ছিল ভারত। কিন্তু নয়াদিল্লি বাণিজ্য সমঝোতার বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে, যাতে ওয়াশিংটন হতাশ এবং বিরক্ত। আমেরিকার ট্রেজ়ারিসচিব স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘‘কী হবে আমি জানি না, এটা ভারতের উপর নির্ভর করছে। ওরা আলোচনার টেবিলে অনেক আগেই চলে এসেছিল। কিন্তু ধীরে এগোচ্ছে। তাই প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের পুরো টিম ওদের উপর বিরক্ত। তা ছাড়া, ভারত তো রাশিয়া থেকে প্রচুর তেল কেনে।’’
মূলত, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির ক্ষেত্রে ভারত নীতিগত এবং অসংঘাতমূলক একটি অবস্থান গ্রহণ করেছিল। অর্থনীতির সুরক্ষার সঙ্গে যাতে শুল্কছাড়ের ভারসাম্য থাকে, যাতে দেশীয় বণিকদের সমালোচনা এড়ানো যায়, সব দিক বিবেচনা করে এগোচ্ছিল দিল্লি। তাতেই দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রথম থেকে এই প্রক্রিয়ার দিকে যাঁরা নজর রেখেছেন, তাঁদের মতে, যে সমস্ত দেশ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাড়াহুড়ো করেছিল, তাদের সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একপেশে চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। এই দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। এই একপেশে চুক্তি এড়াতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
সরকারি সূত্রের দাবি, চিন এবং ভারতের মধ্যে আমেরিকা শুল্কে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পার্থক্য বজায় রাখবে বলে মনে করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ভারতের সীমাবদ্ধতাগুলিও বিবেচনা করার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সয়াবিন, ভুট্টা, দুগ্ধজাত পণ্যের মতো বেশ কিছু কৃষিপণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস চাইছে আমেরিকা। কিন্তু নয়াদিল্লি প্রাথমিক ভাবে তাতে আগ্রহী নয়। আমেরিকার আমদানিতে ৫৫ শতাংশ শুল্কছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। তা আরও কিছুটা বাড়ানো হতে পারে।
সূত্রের দাবি, শুল্কছাড়ের পাশাপাশি আমেরিকার ‘মানভঞ্জনের’ জন্য প্রতিরক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পরমাণু— তিনটি বড় ক্ষেত্রে আমেরিকা থেকে আমদানি বৃদ্ধির কথা ভাবছে দিল্লি। এতে বাণিজ্যঘাটতি অনেকটা কমবে। তবে কৃষিক্ষেত্রে একপেশে চুক্তির ফাঁদ এড়াতে মরিয়া ভারত। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত মোদী ট্রাম্পের আলোচনাতেই এই জট কাটতে পারে। শীঘ্রই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে ফোনে আলোচনা হতে পারে।
এখনও পর্যন্ত আমেরিকার সঙ্গে চুক্তির সময়সীমা অক্টোবর বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক আলোচনা ফলপ্রসূ হলে সময়সীমা আরও এগিয়ে আসতে পারে। কৌতূহলের বিষয় হল, আমেরিকার সঙ্গে চিনও বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। সেটাই নয়াদিল্লির পক্ষে সমীকরণ আরও জটিল করে তুলেছে। এই মুহূর্তে চিনের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এর সঙ্গে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পার্থক্য যাতে থাকে ভারতের শুল্কহারে, সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন ভারতীয় আধিকারিকেরা।