জগদীপ ধনখড়। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকার সময়ে জগদীপ ধনখড় বলেছিলেন, তিনি ‘অপমানিত’ বোধ করছেন।
উপরাষ্ট্রপতি হিসেবেও জগদীপ ধনখড় বেশ কিছু দিন ধরে ‘অপমানিত’ বোধ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, মোদী সরকারের তরফে তাঁকে অপমান করা হচ্ছে। সেই ‘মন কি বাত’ তিনি উপরাষ্ট্রপতি ভবনে বসে একের পর এক বিরোধী দলের নেতাদের কাছে বলতে শুরু করেন। তেলুগু দেশম, রাষ্ট্রীয় লোক দলের মতো বিজেপির শরিক দলের নেতাদের কাছেও ক্ষোভ উগরে দেন। উপরাষ্ট্রপতির এই ‘নালিশ’ মোদী সরকারের শীর্ষ স্তরে পৌঁছতে দেরি হয়নি। সূত্রের খবর, তার পর থেকেই মোদী সরকারের সঙ্গে উপরাষ্ট্রপতির দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। মোদী সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মনেও ধনখড় সম্পর্কে ক্ষোভ তৈরি হয়।
কংগ্রেস শিবিরের মতে, ধনখড় নিজে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা না দিলে এনডিএ-র তরফ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা প্রস্তাব’ আনা হত। তার জন্য সাদা কাগজে এনডিএ সাংসদদের সই সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ গত সোমবার, সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আসন থেকে জগদীপ ধনখড় বিচারপতি যশবন্ত বর্মাকে অপসারণের জন্য শুধু বিরোধীদের সই করা নোটিস জমা পড়ার কথা ঘোষণা করে দেন। তাতেই ধনখড় সম্পর্কে মোদী সরকারের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। কারণ মোদী সরকারের পরিকল্পনা ছিল, এনডিএ এবং বিরোধী সাংসদদের সই করা নোটিসের ভিত্তিতে লোকসভায় অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাতে কান না দিয়ে ধনখড় বিরোধীদের নোটিস জমা পড়ার কথা ঘোষণা করে দিতেই মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।
কংগ্রেস শিবির মনে করছে, বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরাতে অনাস্থা প্রস্তাবের জন্য এনডিএ সাংসদদের সই করাচ্ছে বলে জগদীপ ধনখড় টের পেয়ে যান। তার পরেই তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। আজ কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন সাদা কাগজে এনডিএ সাংসদদের সই সংগ্রহ করা হয়েছিল? সংসদে শুধু বিচারপতি যশবন্ত বর্মা ও বিচারপতি শেখর যাদবের অপসারণের নোটিস জমা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। তা হলে তৃতীয় একটি নোটিসের জন্য কেন সাদা কাগজে সই সংগ্রহ করা হচ্ছিল? মনু সিঙ্ঘভির কটাক্ষ, ‘‘যদি ওই সাদা কাগজে সই সংগ্রহ বিচারপতি বর্মা বা বিচারপতি যাদবের অপসারণের জন্য না হয়ে থাকে, তা হলে কার জন্য হতে পারে, সেটা বুঝতেই পারছেন।’’
উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ধনখড়ের আচমকা ইস্তফার পরে দিল্লির রাজনৈতিক শিবির মনে করছে, এই ঘটনার পরে সংসদে বা সংসদের বাইরে শাসক দলের কোনও মন্ত্রী বা নেতা ঘরোয়া ভাবেও মনের কথা বলতে ভয় পাবেন। এনডিএ-র এক প্রবীণ নেতার মতে, পুরনো সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে মন্ত্রী, সাংসদরা খোলা মনে আড্ডা দিতেন। অতীতে উপরাষ্ট্রপতিরা অন্যান্য দলের নেতা, সাংবাদিকদের ঘরোয়া মধ্যাহ্নভোজনে নিমন্ত্রণ জানাতেন। সেখানে বিজেপি, কংগ্রেসের নেতারা খোলা মনে নিজের দলের নেতৃত্বেরও সমালোচনা করতেন। তার জন্য কাউকে কোনও দিন বিপদে পড়তে হয়নি। কিন্তু ধনখড়-কাণ্ডের পরে ভবিষ্যতে বিজেপির কোনও নেতা-মন্ত্রী ঘরোয়া আলোচনাতেও মুখ খুলতে ভয় পাবেন বলে দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরমনে করছে।
রাজনৈতিক সূত্রের খবর, গত বছর শীতকালীন অধিবেশনে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভায় চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে বিরোধীরা একজোট হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস নিয়মমাফিক হয়নি বলে তা খারিজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পর থেকেই উপরাষ্ট্রপতির বাসভবনে বসে বিরোধী দলের সাংসদদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতেন জগদীপ ধনখড়। কাউকে কাউকে জন্মদিনে ঝর্ণা কলম উপহার দিয়েছেন। সেই সঙ্গে মনের ক্ষোভ উগরে দিতেন। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, তিনি মোদী সরকারের কাজে ‘অপমানিত’ বোধ করছেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকাকালীন ২০১৯-এ দুর্গাপুজোর বিসর্জনের কার্নিভালের পরে ধনখড় বলেছিলেন, তিনি অপমানিত বোধ করছেন। কারণ, রেড রোডের কার্নিভালে তিনি হাজির থাকলেও অনুষ্ঠানের সম্প্রচারে তাঁকে দেখানো হয়নি। উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে ধনখড়ের ক্ষোভ ছিল, তাঁকে যথেষ্ট দ্বিপাক্ষিক সফরে বিদেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে ইরানের প্রেসিডেন্টের প্রয়াণের পরে শেষকৃত্যে যোগ দিতে পাঠানো হচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাঁর পূর্বসূরিদের মতো দ্বিপাক্ষিক সফরে পাঠানো হচ্ছে না। আবার আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স দিল্লিতে এলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে কোনও বৈঠক সফরসূচিতে থাকছে না।
কংগ্রেস নেতাদের মতে, উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে জগদীপ ধনখড় ছিলেন ‘মোর লয়্যাল দ্যান দ্য কিং’। তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর থেকেও মোদী সরকারের বেশি প্রশংসা করতেন। গত বছর জুলাইয়ে রাজ্যসভায় বসে আরএসএসের প্রশংসা করে তিনি বলেছিলেন, আরএসএস একটি ‘গ্লোবাল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’। এই সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু ক্রমশ মোদী সরকার সম্পর্কেই তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। জাঠ নেতা ধনখড় নিজের সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছেও সেই ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন বলে সূত্রের দাবি। সরকারের কথা মতো না চলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে স্বাধীন ভাবে পদক্ষেপ করেছিলেন। কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতে, ‘‘জগদীপ ধনখড় দেরিতে হলেও সামান্য স্বাধীনতা দেখিয়েছিলেন। সেটাই তাঁর আসল ভুল।’’
সোমবার উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে অবশ্য শাসক, বিরোধী কোনও দলের সাংসদের সঙ্গেই দেখা করেননি ধনখড়। যাঁরা ফোন করেছিলেন, তাঁরা মোবাইল বন্ধ পেয়েছেন। দিল্লির চার্চ রোডে নতুন ‘ভাইস প্রেসিডেন্টস এনক্লেভ’-এ উপরাষ্ট্রপতির দফতরে নিযুক্ত সরকারি কর্মীদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিদায় নেওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গেও দেখা করেননি ধনখড়। মোদী সরকারের অন্দরমহলের খবর, জগদীপ ধনখড়কে বিদায় সংবর্ধনা বা তাঁর সম্মানে নৈশভোজের পরিকল্পনা এখনও নেই। তেমন সম্ভাবনাও খুবই কম।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে