বিহারের ভোটার তালিকা মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
বুধবারের শুনানিতে বেশ কিছু বিষয় উঠে আসে। বিহারে কেন এসআইআর প্রক্রিয়া বাতিল চাইছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মামলাকারীর আইনজীবীরা। মামলাকারীর পক্ষের প্রায় সব আইনজীবীই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এখন বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) করা হচ্ছে? ভোটের পর কি করা যেত না?
শুনানিতে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, ‘‘আধার কেন গ্রহণ করা হবে না তার বিপক্ষে যুক্তি আমরা বুঝতে পেরেছি।’’ তিনি জানান, কমিশন যে সব নথি চাইছে তা ভোটার-বান্ধব। বিচারপতি বাগচী জানতে চান, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কত ধরনের নথি ব্যবহার করা যেতে পারে? নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে কমিশনের চাওয়া নথি প্রসঙ্গে বিচারপতি কান্ত বলেন, ‘‘কেউ যদি বলত ওই ১১টি নথির সব চাই, তা হলে সেটা ভোটার বিরোধী হত। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে ১১টির মধ্যে যে কোনও একটি দেওয়ার কথা। তবে আপত্তি কোথায়?’’
আপত্তির কারণ হিসাবে মামলাকারীর আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি জানান, আধার কার্ড গ্রহণ করা হচ্ছে না। জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ প্রায় সকলের বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু সেগুলি বিবেচনা করা হয়নি। পাসপোর্টের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্ট দুই শতাংশের কম ভারতীয়ের রয়েছে। বাকি যা নথি চাওয়া হচ্ছে তা-ও সকলের কাছে নেই। শুনানি জুড়ে এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং সমস্যার কথা তোলেন মামলাকারীর আইনজীবীরা। বুধবারের শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে প্রশাসনকে। তবে কাউকে না কাউকে তো উপায় খুঁজে বার করতে হবে। এর মানে এই নয় যে এই সব সমস্যার কোনও সমাধান নেই।
সওয়াল-জবাব শেষে বুধবারের মতো শুনানি শেষ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আবার বৃহস্পতিবার সকাল সওয়া ১১টা নাগাদ শুনানি হবে বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে।
ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ‘‘আমরা কখনওই মৃতদের ফিরিয়ে আনতে পারব না’’ মামলাকারীর আইনজীবীর পাল্টা সওয়াল, ‘‘যদি কেউ মারা যান, তবে তার নাম অপসারণ করতে পারে কমিশন। তবে যাঁদের নাম ইতিমধ্যেই বাদ দেওয়া হয়েছে, আগে তাঁদের নাম যুক্ত করা হোক, তার পরে এসআইআর প্রক্রিয়া চলতে পারে।’’
বিহারের ভোটার তালিকা মামলায় বুধবার বার বার উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ। আইনজীবী গোপালের সওয়াল, ১০ জুলাই যখন এই মামলা শুনানির জন্য ওঠে তখন ন্যায় বিচারের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ব্যবহার করা হোক। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। তবে আদালত বলার পরেও ভোটার কার্ড বিবেচনা করা হয়নি।’’ তার পরেই ওই আইনজীবী বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া স্থগিতাদেশ দেওয়া হোক। তাতে বাংলাও উপকৃত হবে। শুধুমাত্র একটি তারিখ জানিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারে না কমিশন। আদালতের প্রশ্ন, তবে কি কখনওই কোথাও এই প্রক্রিয়া করা যাবে না? আইনজীবী জানান, সংশোধন অবশ্যই করা উচিত। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, এসআইআর প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখা হোক।
এসআইআর প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কেন ২০০৩ সালের ভোটার তালিকাকে ধরা হচ্ছে? কেন ২০২৫ সালের জানুয়ারির তালিকা ধরা হবে না? বিষয়টি উল্লেখ করে মামলাকারীর আইনজীবী গোপালের উদ্দেশে বিচারপতি বাগচীর মন্তব্য, ‘‘এটা (এসআইআর) প্রথম বারের জন্য করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সকল ভোটার তালিকা বাতিল করা যেত। কিন্তু কমিশন তা করছে না। তারা ২০০৩ সালকে ‘মাইলস্টোন’ হিসাবে ধরে নিচ্ছে।’’ বিচারপতি বাগচী মামলাকারীর আইনজীবীকে বলেন, ‘‘২০০৩ সাল কেন? কেন ২০২৫ সালের জানুয়ারির তালিকা ধরা হবে না? আপনারা এই বিষয়ে সওয়াল করতে পারেন।’’
শুনানিতে মামলাকারীর আইনজীবী গোপালের সওয়াল, ‘‘সংবিধান সব ব্যক্তিকে ভোটার হওয়ার অধিকার দিয়েছে। জনপ্রতিনিধি আইনে ভোটারের সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে।’’ তার পরেই খসড়া ভোটার তালিকায় নাম বাদ যাওযার প্রসঙ্গ নিয়ে গোপালের মন্তব্য, ‘‘কমিশন গণহারে নাম বাদ দিয়েছে। ভোট দেওয়া আমার অধিকার। ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে গর্ব করে। কমিশন কী ভাবে ভোটারদের সঙ্গে এই রকম ছেলেখেলা করতে পারে?’’
গত ৮ অগস্ট ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) করা হবে বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নোটিস পাঠায় নির্বাচন কমিশন। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই এই বিষয়টি কমিশনের তরফে জানানো হয়। বুধবারের শুনানিতে সেই প্রসঙ্গ তোলেন মামলাকারীর আইনজীবী গোপালশঙ্কর নারায়ণ। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গেও কোনও আলোচনা ছাড়া শুরু হতে পারে নিবিড় সমীক্ষা।’’
শুনানিতে বিচারপতি কান্তের মন্তব্য, ‘‘বিহার থেকে সবচেয়ে বেশি আইএএস অফিসার আসেন। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ না থাকলে এটা কি সম্ভব?’’ বিচারপতির প্রশ্নের উত্তরে মামলাকারীর আইনজীবী সিঙ্ঘভি বলেন, ‘‘সেই সংখ্যাটা কয়েকটি শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ।’’ তার পরেই তাঁর দাবি, ‘‘আমরা এসআইআরের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু ভোটের আগে কেন? পরে সারা বছর ধরে করা যেত।’’
আইনজীবী সিঙ্ঘভি আদালতে দাবি করেন, কমিশন নিজেই তাদের তৈরি ভোটার কার্ড গ্রহণ করছে না। তার পরেই আইনজীবী সিঙ্ঘভি বলেন, ‘‘বিহারের বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কমিশনের চাওয়া নথি নেই। ২০০১ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৪ কোটি জন্ম সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। মাত্র ৩৬ লক্ষের কাছে পাসপোর্ট রয়েছে।’’
কমিশনের নথি চাওয়ার বিষয়ে কেন আপত্তি রয়েছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করলেন আইনজীবী সিঙ্ঘভি। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘তবুও আমরা বিরোধিতা করছি। তার কারণ ব্যাখ্যা করব।’’ তার পরেই সিঙ্ঘভি বলেন, ‘‘আধার কার্ড গ্রহণ করা হচ্ছে না। জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ প্রায় সকলের বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু সেগুলি বিবেচনা করা হয়নি। পাসপোর্টের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাসপোর্ট দুই শতাংশের কম ভারতীয়ের রয়েছে। বাকি যা নথি চাওয়া হচ্ছে তা-ও সকলের কাছে নেই। যদি কারও জমি না থাকে, তবে তালিকার ৫, ৬, ৭ নম্বর নথি বাদ যাবে।’’ এই বিষয় উল্লেখ করে আইনজীবী সিঙ্ঘভির মন্তব্য, ‘‘আমি ভাবছি, বিহারে কত জন যোগ্য হবেন? বিহারে রেসিডেন্স সার্টিফিকেট (স্থায়ী ভাবে বসবাসের শংসাপত্র) বলে কিছু নেই।’’
আধার নিয়ে মঙ্গলবারই সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিল। বুধবারের শুনানিতে সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, ‘‘আধার কেন গ্রহণ করা হবে না তার বিপক্ষে যুক্তি আমরা বুঝতে পেরেছি।’’ তিনি জানান, কমিশন যে সব নথি চাইছে তা ভোটার-বান্ধব। বিচারপতি বাগচী জানতে চান, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কত ধরনের নথি ব্যবহার করা যেতে পারে? নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে কমিশনের চাওয়া নথি প্রসঙ্গে বিচারপতি কান্ত বলেন, ‘‘কেউ যদি বলত ওই ১১টি নথির সব চাই, তা হলে সেটা ভোটার বিরোধী হত। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে ১১টির মধ্যে যে কোনও একটি দেওয়ার কথা। তবে আপত্তি কোথায়?’’
শুনানির শুরুতে আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর দাবি, ‘‘গত লোকসভা নির্বাচনে যাঁদের নাম ছিল, খসড়া তালিকায় তাঁদের মধ্যে অনেকের নাম বাদ গিয়েছে।’’ কেন এবং কোন পদ্ধতিতে কমিশন নাম বাদ দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তিনি আরও বলেন, ‘‘কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকলে ইআরও (নির্বাচন নিবন্ধন আধিকারিক) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পরামর্শ নিন। অথবা, তাঁর উচিত এই সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম আগের রায়গুলি বিবেচনা করা।’’
বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া মামলার শুনানি শুরু হল বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে।
আধার কার্ড কি এক জন ভারতীয়ের নাগরিকত্বের প্রমাণ? এ নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি কমিশন জানিয়েছিল, আধার নথিকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। মঙ্গলবারের শুনানিতে কমিশনের সেই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে শীর্ষ আদালত। বিচারপতি সূর্য কান্তের পর্যবেক্ষণ, আধার নথিকে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসাবে নেওয়া যায় না বলে জানাচ্ছে কমিশন। তারা ঠিকই বলছে। এই নথির ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আলাদা করে যাচাই করতে হবে।
মঙ্গলবারের পর বুধবারও সুপ্রিম কোর্টে রয়েছে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) সম্পর্কিত মামলার শুনানি। এই শুনানি চলছে বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে। ইতিমধ্যে বিহারে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে প্রায় ৬৫ লক্ষের নাম বাদ গিয়েছে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামাও জমা দিয়েছে কমিশন। শনিবার আদালতে জমা দেওয়া ওই হলফনামায় কমিশন বলেছে, সে রাজ্যের ভোটার তালিকায় থাকা ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার আগে নোটিস ধরানো হবে। সেখানে উল্লেখ থাকবে, কী কারণে ওই নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে।