বিহারে এসআইআর সংক্রান্ত মামলা। —ফাইল চিত্র।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টা নাগাদ বিহারের ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) সংক্রান্ত মামলার শুনানির শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টে। দীর্ঘ সময় ধরে চলে শুনানি। মাঝে কিছু ক্ষণের বিরতির পর বিকেল ৪টে পর্যন্ত এই মামলা শোনেন বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। মঙ্গলবারের শুনানিতে ফের উঠে এসেছে আধার নথির প্রসঙ্গ। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ, আধার নাগরিকত্বের প্রমাণ হতে পারে না। এই নথির ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আলাদা করে যাচাই করা প্রয়োজন বলেই মনে করছে সুপ্রিম কোর্ট।
নির্বাচন কমিশন আগেই হলফনামা দিয়ে আধার নথির প্রসঙ্গে নিজেদের আপত্তির কথা সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল। আধার নথি কোনও নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বলেই সেই সময় জানিয়েছিল কমিশন। মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতের মন্তব্য, “নির্বাচন কমিশনই ঠিক। আধার নথি নাগরিকত্বের প্রমাণ হতে পারে না।”
তবে কমিশনের এই বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন করার এক্তিয়ার রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠে আসে আদালতে। শুনানির এক পর্যায়ে বিচারপতি কান্ত বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এই প্রক্রিয়া (এসআইআর) করার ক্ষমতা রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে। ২০০৩ সাল হোক অথবা ২০১৩ সাল, তাতে কিছু যায় আসে না।”
মামলার শুনানি চলাকালীন আইনজীবী কপিল সিব্বল আদালতে জানান, আবেদন করার জন্য কমিশন যে নথিগুলির কথা বলছে, যদি তা কারও কাছে না থাকে, তবে তিনি কী ভাবে আবেদন করবেন? যদিও বিচারপতি কান্ত বলেন, “ফর্মে (আবেদনপত্রে) কোথায় লেখা আছে সব নথি থাকা বাধ্যতামূলক?” তিনি আরও বলেন, “নাগরিকত্বের জন্য কোনও একটি নথি অবশ্যই থাকতে হবে। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নথি রয়েছে। একটি সিমকার্ড কিনতে গেলেও নথি দিতে হয়। উদাহরণ হিসাবে বলছি, জাতিগত শংসাপত্রও অনেকে দিতে পারেন। কোনও নথি অবশ্যই রয়েছে। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক দেওয়া কোনও না কোনও নথি কমিশন তো গ্রহণ করছে।”
নির্বাচন কমিশন আগেই জানিয়েছিল আধার নথিকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। এ বার কমিশনের সঙ্গে সহমত সুপ্রিম কোর্টও। শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সূর্য কান্তের পর্যবেক্ষণ, আধার নথিকে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসাবে নেওয়া যায় না বলে জানাচ্ছে কমিশন। তারা ঠিকই বলছে। এই নথির ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আলাদা করে যাচাই করতে হবে।
বুধবার ফের এই মামলার শুনানি রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
আইনজীবী সিঙ্ঘভি আরও বলেন, “এই পুরো প্রক্রিয়া এক্তিয়ার বহির্ভূত। নাগরিকত্ব নির্ধারণ কমিশনের কাজ নয়। নির্বাচনের দু’মাস আগে তারা এসআইআর শুরু করে ভোটার বাদ দিতে পারে না। নাগরিকত্বের কারণে কাউকে বাদ দিতে হলে, প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। যদি কমিশনের পরীক্ষায় আপনি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারেন, তবে ধরে নেওয়া হচ্ছে ২০০৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আপনি ভোটার তালিকা থেকে বাদ।”
আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি মঙ্গলবার ফের আধার কার্ড এবং ভোটার কার্ডের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর প্রশ্ন, “আধার এবং ভোটার কার্ড গ্রহণ করতে কমিশনের আপত্তি কোথায়? নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বলেই কি আপত্তি কমিশনের?”
দিল্লিতে বসবাসকারী বিহারের ভোটারদের হয়ে আদালতে সওয়াল করেন আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। তাঁদেরও খসড়া তালিকায় নাম ওঠেনি বলে অভিযোগ। আইনজীবীর বক্তব্য, “সংসদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার নিয়ম সংসদ দ্বারা পাশ হয়নি। কেন এই ১১টি নথি বেছে নেওয়া হল? কমিশন কী ভাবে এটা ঠিক করল?”
কমিশনের আইনজীবী বলেন, “২০০৩ সালের তালিকা যে কেউ দেখতে পাবেন। এর জন্য কোনও নথি লাগবে না। কারও কাছে যেতে হবে না।” তখন বিচারপতি কান্ত বলেন, “হতে পারে বিশ্বাসের উপর ঘাটতি থেকে কমিশনকে বলা হচ্ছে।”
একটি সংগঠনের হয়ে আদালতে সওয়াল করেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। তিনি জানান, কোনও তালিকা দেওয়া হয়নি। পাল্টা কমিশনের আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী জানান, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আদালতকে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। তখন প্রশান্তও বলেন, “আগে খসড়া ভোটার তালিকা পাওয়া যেত। সেটি যে কেউ দেখতে পেতেন। এখন কমিশন বলছে রাজনৈতিক দলের এজেন্টদের কাছে যেতে। এক জন ব্যক্তি কেন তাঁদের কাছে যাবেন?” তখন বিচারপতি কান্ত বলেন, “এক জন ভোটারের তালিকা দেখার অধিকার রয়েছে।”
বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, “এই সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে মৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া। মৃত ব্যক্তিরা রয়েছেন কি না তা দেখার। এটা ড্রাফ্ট (খসড়া) তালিকা। এই তালিকা রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া হয়। সেখানে কোনও আপত্তি থাকলে তারা জানাক। কিন্তু ভুল তথ্য দিলে কমিশন তো যাচাই করবে।”
বিচারপতি কান্ত বলেন, কারও নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, “এটি কি আশঙ্কা? না কি এর সত্যতা রয়েছে? তা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।” তিনি আরও বলেন, “৭ কোটি ২৪ লক্ষ ভোটার আবেদন জমা দিয়েছে। (বাদ পড়া) ৬৫ লক্ষের মধ্যে ২২ লক্ষ মৃত, তা নিয়ে কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়। ৩৬ লক্ষ অন্যত্র চলে গিয়েছে। আপনাদের কাছে স্থানান্তরিত ভোটার নিয়ে একটা ধূসর এলাকা থাকতে পারে!”
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারপতি কান্ত বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এই প্রক্রিয়া (এসআইআর) করার ক্ষমতা রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে। ২০০৩ সাল হোক অথবা ২০১৩ সাল, তাতে কিছু যায় আসে না।”
আদালতে আইনজীবী সিব্বল জানান, যখন এই আবেদনপত্র জমা দেওয়া হচ্ছে, তার যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কমিশন পাল্টা কোনও ‘রিসিপ্ট’ (রশিদ) দিচ্ছে না।
বিচারপতি কান্ত বলেন, “কোনও নথি অবশ্যই রয়েছে। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক দেওয়া কোনও না কোনও নথি কমিশন তো গ্রহণ করছে।” মামলাকারীর উদ্দেশে বিচারপতির প্রশ্ন, “আধার বা রেশন কার্ড ছাড়া বিহারের বেশির ভাগ মানুষের অন্য কোনও নথি নেই, কী ভাবে এই দাবি করছেন?”
বিরতির পরে দুপুর ২টো নাগাদ ফের শুরু হয় শুনানি। তখন বিচারপতি কান্তের প্রশ্ন, “ফর্মে (আবেদনপত্রে) কোথায় লেখা আছে সব নথি থাকা বাধ্যতামূলক?” তিনি আরও বলেন, “নাগরিকত্বের জন্য কোনও একটি নথি অবশ্যই থাকতে হবে। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নথি রয়েছে। একটি সিমকার্ড কিনতে গেলেও নথি দিতে হয়। উদাহরণ হিসাবে বলছি, জাতিগত শংসাপত্রও অনেকে দিতে পারেন।”
আইনজীবী সিব্বল আদালতে বলেন, “অনেক সময় কমিশন যে সব তথ্য চাইছে, আমার কাছে সেই সব তথ্য নেই। তখন কী ভাবে আবেদন গ্রহণ হবে?”
দুপুর ২টোয় ফের এই মামলার শুনানি হবে বলে জানিয়েছে আদালত।
অন্য দিকে কমিশনের আইনজীবী জানান, এটি একটি খসড়া তালিকা। তিনি বলেন, “আমরা নোটিস দিয়েছে। কারও কোনও আপত্তি থাকলে জানাবেন। কিছু ত্রুটি সেখানে থাকতে পারে। আপত্তি জানিয়ে আবেদন করলে কমিশন ঠিক করে দেবে। কোনও ব্যক্তি জীবিত বা মৃত হলে তা নিয়ে আপত্তি জানাতে হবে। কমিশন সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করবে।”
আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, “একটি বিধানসভা এলাকায় ১২ জনকে জীবিত দেখানো হয়েছে। অথচ তাঁরা মৃত। আবার অন্যত্র মৃত ভোটারদের জীবিত বলে দেখানো হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বিএলও-রা কী কাজ করেছেন? তাঁদের যাচাই কাজ সঠিক ভাবে হয়নি।”
শুনানির একটি পর্যায়ে বিচারপতি সূর্য কান্ত বলেন, “যাঁদের আপত্তি তাঁরা কোথায়, তাঁদের তালিকা জমা দিন।” তবে সিব্বল জানান, অনেক বুথে এই রকম ঘটনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মামলাকারী পক্ষ কী ভাবে তা ট্র্যাক করবে, তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলেন সিব্বল।
মঙ্গলবার দুপুর ১টার কিছু আগে বিহারে বিশেষ এবং নিবিড় সমীক্ষার শুনানি শুরু হয়। আইনজীবী গোপাল সুব্রহ্মণ্যম জানান, গত শুনানিতে বিচারপতি বাগচী মন্তব্য করেছিলেন গণহারে নাম বাদ গেলে আদালত হস্তক্ষেপ করবে। ৬৫ লক্ষ লোকের নাম বাদ দিয়েছে। বিচারপতি সূর্য কান্ত জানান, নথি যাচাই করে আদালত ওই বিষয়টি দেখবে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কমিশন জানিয়েছে, নোটিস না-দিয়ে কোনও ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হবে না বিহারে। শনিবার আদালতে জমা দেওয়া ওই হলফনামায় কমিশন বলেছে, সে রাজ্যের ভোটার তালিকায় থাকা ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার আগে নোটিস ধরানো হবে। সেখানে উল্লেখ থাকবে, কী কারণে ওই নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। হলফনামায় এ-ও বলা হয়েছে যে, সাধারণ ন্যায়বিচারের নীতি মেনেই ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ গিয়েছে এমন কেউ কমিশনকে নিজেদের বক্তব্য জানাতে পারবেন এবং নিজের দাবির সপক্ষে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে পারবেন।
বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ এবং নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতে এই মামলার শুনানি রয়েছে বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে। ইতিমধ্যে বিহারে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে কমিশন। সেখানে প্রায় ৬৫ লক্ষের নাম বাদ গিয়েছে। তা নিয়ে বিরোধী দলগুলির প্রশ্নের মুখে পড়েছে তারা। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ফের বিহারের এসআইআর মামলা শুনানির জন্য উঠছে শীর্ষ আদালতে।