ঝকঝকে বিশাল দফতর। যেন এসে পড়েছি কোনও কর্পোরেট অফিসে। কিন্তু সেখানেও জায়গায় টান পড়েছে। মিডিয়া সেলের জন্য বরাদ্দ আস্ত একটা হোটেল। সেখানে শ’খানেক কর্মী দিন-রাত এক করে লড়াই চালাচ্ছেন।
বিজেপির কর্নাটকের রাজ্য দফতর দেখে প্রথমে চোখ কপালে উঠেছিল। কপাল ছাড়িয়ে চোখ মাথার মাঝখানে পৌঁছে গেল, আইটি সেলের এক কর্তার সঙ্গে কথা বলে। হোটেলেই সব কর্মীদের জন্য খাবার ব্যবস্থা। সেখানে দক্ষিণী খাবার খেতে খেতে ওই যুবক বললেন, ‘‘গোটা রাজ্যে দশ হাজার কর্মীকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগানো হয়েছে। যে ভাবেই হোক, গতবারের সব ক’টি জেতা আসন ধরে রাখতেই হবে।’’
কর্নাটকে এটাই এখন বিজেপির জপমন্ত্র। ২৮ আসনের কর্নাটকে গত লোকসভায় বিজেপির হাতে ছিল ১৭টি। দক্ষিণী কোনও রাজ্য গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে এত আসন দেয়নি। দশ মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনেও ২২৪টার মধ্যে বিজেপি একাই ১০৪। ম্যাজিক সংখ্যা থেকে মাত্র তিনটি কম।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। বিএস ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে সরকার তৈরির পরেও বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দিল কংগ্রেসের এক ধুরন্ধর চাল। চিরশত্রু জনতা দল (সেকুলার) নেতা দেবগৌড়া-পুত্র এইচডি কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে জোট সরকার গড়ে ফেলল কংগ্রেস। বিধানসভায় কংগ্রেসের ৭৯টি আসনের সঙ্গে জেডিএসের ৩৭টি ও বিএসপির একটি যোগ করে আসন হচ্ছে ১১৭। এমন রামধাক্কা খাওয়ার শোক এখনও ভুলতে পারেননি দিল্লি-বেঙ্গালুরুর বিজেপি নেতারা। মাঝেমাঝেই কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিধায়ক কেনাবেচার চেষ্টার অভিযোগ (যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন লোটাস’) উঠছে তাঁদের বিরুদ্ধে। সে কাজেও সাফল্য আসেনি। এ বারের লোকসভা ভোটে বিজেপি তাই তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়েছে। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, রসদে কোনও কার্পণ্য নেই এখানে। বিজেপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সংগঠক শ্রীধর বলেন, ‘‘সকলে এককাট্টা হয়ে লড়াই শুরু করেছি।’’
লড়াই-ই বটে! বিধানসভায় বৃহত্তম দল হলেও পরিসংখ্যান বলছে দশ মাস আগের ওই ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস তাদের চেয়ে ৩৩টি আসন কম পেলেও ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। জেডি(এস) পায় ১৮ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস-জেডি(এস) নেতৃত্বের আশা, লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের জোট ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে। সেটাই কপালে ভাঁজ ফেলেছে বিজেপি নেতাদের। মিডিয়া সেলে তিনটে কম্পিউটার, শ’খানেক যোদ্ধা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দশ হাজার নারায়ণী সেনা নামিয়েও তাই প্রবল চিন্তায় বিজেপি নেতারা।
বিজেপি নেতাদের আশঙ্কার মূল কারণ অবশ্য কর্নাটকের জাতপাতের অঙ্ক। রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী দু’টি সম্প্রদায় হল লিঙ্গায়েত (১৮ শতাংশ) এবং ভোক্কালিগা (১৪ শতাংশ)। বিজেপির দাবি, লিঙ্গায়েতরা বরাবরই রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে। প্রার্থী নির্বাচনের সময়েও বিজেপি তাই বেছে বেছে ওই সম্প্রদায় থেকেই প্রার্থী করেছে। ভোক্কালিগারা আবার জেডি(এস)-এর ভোটব্যাঙ্ক বলে পরিচিত। এইচডি দেবগৌড়া নিজেও এই সম্প্রদায়ের। ওই দুই সম্প্রদায় ছাড়াও কুরবা সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এই সম্প্রদায়ের নেতা কংগ্রেসের সিদ্দারামাইয়া। তবে তিনি নিজেকে কুরবা সম্প্রদায়ের মধ্যেই না রেখে সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন মুসলিম (১৩ শতাংশ) এবং খ্রিস্টানদেরও (৪ শতাংশ)। বিজেপির বিরুদ্ধে সিদ্দারামাইয়ার এই জোটকে স্থানীয়েরা বলেন ‘আহিনদা’। এই জোটই গত বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাই এ বার তাদের সঙ্গে ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের ভোট জুড়ে যাওয়া বিজেপির কাছে শঙ্কার বিষয়। গতবারের মোদী-ঝড়ে পাওয়া ১৭টি আসন এ বার ধরে রাখা এখন তাদের কাছে সবচেয়ে
বড় চ্যালেঞ্জ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বিজেপি দফতরের তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ প্রদেশ কংগ্রেস অফিস। একতলায় তৈরি হয়েছে ওয়ার রুম। সেখানে জনা তিনেক কর্মী। উপরতলায় ফোন সামলাচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ভিওয়াই গোড়পড়ে। তিনিও বলেন, ‘‘জাতি-ধর্ম দেখেই প্রার্থী করেছি। গতবারের ত্রিমুখী লড়াইতে আমরা পেয়েছিলাম ৯টি, জেডি (এস) ২টি। এ বার জোট অন্তত ২০টি আসন পাবে। দক্ষিণ কর্নাটকের মহীশূর অঞ্চলে বিজেপি একটাও আসন পাবে না। উত্তরেও ওদের আগের থেকে আসন কমবে। মরিয়া হয়ে ওরা এখন দেদার টাকা ছড়াতে শুরু করেছে।’’ জাতের এই চাল দিয়ে এখন নিশ্চিন্তের হাসি কংগ্রেস নেতাদের মুখে।
বেঙ্গালুরুর বিজেপি-কংগ্রেস দফতরে যখন যুদ্ধকালীন তৎপরতা, তখন জেডি(এস)-এর বিশাল দফতর কার্যত খাঁ খাঁ করছে। নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, দোতলায় রয়েছেন অফিস-ম্যানেজার। পরিচয় দিতে তিনি বললেন, ‘‘বিকেল সাড়ে চারটের থাকবেন দলের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট নারায়ণ রাও।’’ কিন্তু এত বড় পার্টি অফিস, কথা বলার মতো আর কোনও নেতা নেই? ‘আর কোনও নেতা’ কথাটা ম্যানেজার সাহেব নিজের
মনেই দু’বার আওড়ালেন। তার পর বললেন, ‘‘আমাদের নেতা বলতে তো দেবগৌড়া আর কুমারস্বামী।
তাঁরাই সব!’’
বেঙ্গালুরুর প্রবীণ সাংবাদিক এম বাসুকি বলেছিলেন, ‘‘জেডি (এস) তো পরিবারিক দল! বাবা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, ৮৬ বছর বয়সেও প্রার্থী। এক ছেলে মুখ্যমন্ত্রী, অন্য ছেলে রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী। দুই নাতি, নিখিল ও প্রজ্জ্বলও এই ভোটে প্রার্থী। মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী বিধায়ক। পূর্তমন্ত্রীর স্ত্রী জেলা পরিষদের সভাধিপতি। কেউ বাদ নেই।’’ বিকেলে ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্টকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতেই, এক গাল হেসে বলেন, ‘‘আসল কথাটা খোলাখুলিই বলি। এখানে বিধায়ক-সাংসদ কেনাবেচার জন্য কোটি কোটি টাকা উড়ছে। কে কোথায় বিকিয়ে যাবে আগে থেকে কাকপক্ষীও টের পায় না। তাই আসন যতটা সম্ভব নিজেদের পরিবারের মধ্যে রাখাই ভাল। তাতে অন্তত এই ভয়টা থাকে না।’’
জেডি (এস) দফতরের নাম জেপি ভবন। দেবগৌড়ার পাশে টাঙানো জয়প্রকাশ নারায়ণের বড় ছবি। জেপি হাসছেন!