বড় বৌমা ডিম্পল ও ছোট বৌমা অপর্ণা
নাটকের এক একটা অঙ্ক দেখে কেউ বলছেন, বাবা-ছেলের মনোমালিন্য। কারও মতে, ‘কৈকেয়ীর মন্ত্রণায় দশরথের মতিভ্রম’। কেউ দেখছেন, ভাইপোর বিরুদ্ধে কাকার ষড়যন্ত্র। তবে পোড়খাওয়া কেউ কেউ একটা চতুর্থ ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন।
তাঁরা বলছেন, আসন্ন ভোটের সমাজবাদী পার্টির অন্দরের লড়াইটা আসলে হতে চলেছে মুলায়ম সিংহ যাদবের দুই বৌমার। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের স্ত্রী ডিম্পল এবং অখিলেশের সৎ-ভাই প্রতীকের স্ত্রী অপর্ণার। পর্দার আড়ালে সংঘাতের আবহে জড়িয়ে পড়েছেন দুই পুত্রবধূ।
অখিলেশ শিবির মনে করে, বাবা-ছেলের মনোমালিন্যের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রয়েছে মুলায়মের দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা এবং তাঁর বৌমা অপর্ণার। এই দু’জনে মিলেই অখিলেশ-ডিম্পলের বিরুদ্ধে মুলায়মকে উস্কে দিচ্ছেন। এমনকী এই নেতাদের দাবি, অপর্ণা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পর থেকেই মুলায়মের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে অখিলেশের। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন মুলায়মের ভাই শিবপাল এবং অমর সিংহ।
সাধনা মনে করেন, প্রতীকেরও সমান অধিকার রয়েছে লখনউয়ের তখ্তে। কিন্তু কুস্তিগির প্রতীক রাজনীতিতে আগ্রহী নন। সাধনার বাজি তাই অপর্ণা। ডিম্পল ইতিমধ্যেই লোকসভার সাংসদ হয়ে রাজনীতির ময়দানে কয়েক পাক এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন বিয়ের দশ বছরের মাথায়। সেখানে মাত্র পাঁচ বছর আগে বিয়ে হওয়া অপর্ণা ইতিমধ্যেই আসন্ন ভোটে লখনউ ক্যান্টনমেন্ট আসনের ঘোষিত প্রার্থী। তাঁকে জেতাতে পূর্ণশক্তিতে নেমে পড়েছেন শিবপাল।
প্রাক্তন কংগ্রেস, অধুনা বিজেপি নেত্রী রীতা বহুগুণা জোশী বরাবর জিতে এসেছেন এই আসনে। অপর্ণার জন্য তাই সহজ কোনও আসন চেয়েছিলেন সাধনা। বারণ করেন অপর্ণাই। এক দিন সাংবাদিক পিতাকে তিনি বলেছিলেন, বিয়ে করলে প্রতীককেই করবেন। তেমনই এখানেও জানিয়ে দেন, হারা আসন থেকে জিতে এসেই সক্রিয় রাজনীতিতে পা দেবেন তিনি। নাম ঘোষণার পর থেকেই ওই বিধানসভা এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন সমর্থকদের ‘অপর্ণা দিদি।’
শিবপাল বিলক্ষণ জানেন, ‘অখিলেশ কাঁটা’ সরাতে হবে দাদার পরিবারের কাউকে দিয়েই। প্রতীক নন রাজি, তাই অপর্ণাই বাজি। সাধনা-শিবপাল-অমরের অক্ষ আসলে চায়, অপর্ণাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে। যে তরুণ নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখিয়ে অখিলেশ প্রচার চালাচ্ছেন, সেই যুক্তিতেই বয়সে আরও ছোট অপর্ণাকে তাঁর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরে নির্বাচনে যেতে চান তাঁরা। তাই শুরু থেকেই এই ত্রিমূর্তি মুলায়মকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন, কোনও ভাবেই যেন ভোটের আগে অখিলেশকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা না হয়। ‘দ্বিতীয়া’র আব্দার ফেলতে পারেননি সত্তোরার্ধ্ব মুলায়ম। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন। অখিলেশ-ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, অপর্ণা জিতলে মুলায়মকে প্রভাবিত করে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসাতে চাইবেন শিবপালরা।
কারণ, সে ক্ষেত্রে তাঁরা সহজেই সরকারের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারবেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, শেষ পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে অখিলেশের অস্ত্র হতে পারেন ডিম্পল। স্ত্রীকে পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী পদপার্থী হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তিনি। নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিও সহায়ক হবে অখিলেশের। তিনি বার্তা দিতে পারেন, ডিম্পল কুর্সিতে বসলেও নেপথ্যে থাকবেন সেই অখিলেশ যাদবই। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, সে ক্ষেত্রে যাদব পরিবারে ক্ষমতার চাবিকাঠির মূল লড়াইটা হয়ে দাঁড়াবে ডিম্পল বনাম অপর্ণা।
মুলায়মের দুই পুত্রবধূর মিল সামান্যই— দু’জনেই ক্ষয়িত্র রাজপুত। ডিম্পলের বাপের বাড়ি উত্তরাখণ্ডে, অপর্ণা লখউয়েরই মেয়ে। ডিম্পল মিতভাষী, শান্ত। অপর্ণা সর্বদাই অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নিজস্বী তোলা থেকে শুরু করে বিজেপি সরকারের স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচির প্রশংসা তিনি খোলাখুলি করেন। তেমনই শ্বশুর যখন ধর্ষণ-প্রশ্নে পুরুষদের পাশে দাঁড়ান, তখন তাঁর বিরোধিতা করতেও পিছপা হন না। ডিম্পলকে রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় সংখ্যালঘু আবেগ মাথায় রাখতে হয়। আর অপর্ণা গোমাংস খাওয়ার বিরোধিতা করেন প্রকাশ্যে। সপা নেতারাই বলেন, ‘এক জন উত্তর, তো অন্য জন দক্ষিণ।’
গত কাল ‘বহিষ্কৃত’ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সফল ভাবে শক্তি প্রদর্শন করে দলে ফিরেছেন অখিলেশ। মুলায়ম ফের বড় ছেলের উপরে আস্থা রাখলে চিন্তা নেই। কিন্তু তা যদি না হয়? গত তিন দশক ধরে গাঁধী পরিবারের দুই পুত্রবধূর ঠান্ডা লড়াই দেখেছে ভারতীয় রাজনীতি। যাদব পরিবারেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না, তখন সেটাই হবে দেখার।
আরও পড়ুন: সপা নাটকে এবার অভ্যুত্থান পর্ব! নেতাজিকে সরিয়ে সভাপতি অখিলেশ