স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দানা মাঝির। ছবি: ফেসবুক।
সতীর মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ শিবের নটরাজনৃত্যে কেঁপে উঠেছিল ধরিত্রী। সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়কাণ্ড বাঁধিয়েছিলেন মহাদেব। কিন্তু, ওড়িশার দানা মাঝি কার উপরেই বা রাগ করবেন! চরম অভাবই তাঁর শত্রু। আর সেই অভাবের কারণেই হাসপাতালে মারা যাওয়া স্ত্রীর দেহ কাঁধে ফেলে ৬০ কিলোমিটার দূরে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন তিনি। ঘটনাস্থল ওড়িশার সেই কালাহান্ডি। বছর তিরিশেক আগে যেখানে অনাহারে ম়ৃত্যুর খবরে উথালপাথাল হয়েছিল দেশ।
দানা মাঝির স্ত্রী বহু দিন ধরেই যক্ষ্মাতে ভুগছিলেন। কালাহান্ডির হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছিল তাঁর। বুধবার সেখানেই মারা যান ৪২ বছরের আমঙ্গ। দিন আনা দিন খাওয়ার জীবনে যেটুকু সম্বল ছিল তা স্ত্রীর চিকিৎসা করাতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী যে মারা যাবেন, তা অবশ্য আগেই টের পেয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, স্ত্রীকে বাঁচাতে গেলে আরও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। যার ব্যয়ভার তাঁর পক্ষে বহন করা অসম্ভব ছিল। ফলে ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেয়ে চোখের সামনেই আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন স্ত্রী। স্ত্রী যখন চূড়ান্ত মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন, দানা মাঝিও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। গরিব হওয়ার যন্ত্রণায়। মনে মনে হয়তো নিজেকে আশ্বস্ত করেছিলেন এটা ভেবে যে, মারা গেলে এই গরিব হওয়ার যন্ত্রণা থেকে অন্তত মুক্তি পাবেন স্ত্রী। কিন্তু, মারা যাওয়ার পরও এই যন্ত্রণা যে পিছু ছাড়ার নয়!
আরও পড়ুন: মশার দিল্লিতে গোপাল শোবেন মশারি ফেলেই
স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেহ বাড়ি নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু করেন দানা। কিন্তু, দেহ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আনতে গেলে তো গাড়ি লাগবে। আর গাড়ি ভাড়া করতে গেলে তো বেশ কিছু টাকা লাগবে। কোথায় পাবেন সেই টাকা! সরকারি প্রকল্প ‘মহাপ্রয়াণ’ অনুযায়ী গরিবদের জন্য বিনামূল্যে যে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রয়েছে, তাও ভাগ্যে জোটেনি দানার। ফলে বিহ্বল দানা আর তাঁর মেয়ে গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্য ডাক্তারদের হাতে-পায়ে ধরতে শুরু করেন। হাসপাতালের কর্মীদের কাছ থেকেও সাহায্য ভিক্ষা চান। কিন্তু, তাঁদের চোখের জল আসলে ‘পাষাণ’ হৃদয় ভেদ করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শেষমেষ মৃতদেহ কাপড়ে জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়েই রওনা দিতে হয় দানাকে। বাবার পায়ে পা মিলিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই এই ১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পার করে ফেলে তাঁর ১২ বছরের মেয়েও। হাসপাতাল থেকে এই ১০ কিলোমিটার রাস্তা পর্যন্ত সবাই শুধু দাঁড়িয়ে দেখলেন। কেউ কেউ আবার দূরে দাঁড়িয়ে করুণাও দেখালেন। কিন্তু সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন না কেউই। তারপর অবশ্য এক সাংবাদিকের চেষ্টায় বাকি রাস্তার জন্য একটা অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা হয়েছিল। ফলে বাকি ৫০ কিলোমিটার আর স্ত্রীকে কাঁধে বয়ে হাঁটতে হয়নি দানাকে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই ঘটনায় দেশজুড়ে হইচই হওয়ার পর ঘটনার তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে ওড়িশা সরকার। কেন দানা মাঝিকে হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়া হয়নি, তদন্ত করে তা দ্রুত কালাহান্ডির জেলাশাসককে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে ওড়িশা সরকার।