লোকসভায় জয় কোনও এক ব্যক্তির নয় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের এই মন্তব্য যে নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশেই, তা স্পষ্ট সব মহলের কাছেই। কিন্তু বিরোধী পক্ষের অবস্থা এতটাই বেহাল যে, তারা মোদীকে আক্রমণ করা দূর, একে সঙ্ঘ-বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব বলে কটাক্ষ করেই ক্ষাম্ত হয়েছে! কিন্তু তবে ভাগবতের মুখে ‘হিন্দুস্তানের সব নাগরিক হিন্দু’, এই মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে গোটা বিরোধী শিবির। সরসঙ্ঘচালকের ওই মন্তব্যটি নিয়ে আজ দিনভর নানা স্তরে তুমুল বিতর্ক হয়েছে।
গত কাল ওড়িশায় এক অনুষ্ঠানে ভাগবত বলেন, “ইংল্যান্ডে বসবাসকারী সকলে যদি ইংরেজ, জার্মানিতে জার্মান ও আমেরিকায় আমেরিকান হন, তা হলে হিন্দুস্তানে বসবাসকারী সকলে কেন হিন্দু হবেন না?” লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকেই হিন্দুত্ব নিয়ে সুর ক্রমশ চড়া করতে শুরু করেছেন সঙ্ঘ নেতৃত্ব। ক’দিন আগেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা অশোক সিঙ্ঘল বলেছিলেন, “সংখ্যালঘুদের বোঝা উচিত, তাঁদের ছাড়াও কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসা যায়।” আরও একধাপ এগিয়ে ভাগবত এ বার বললেন, হিন্দুস্তানের সব নাগরিকই হিন্দু।
সঙ্ঘের হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনা অবশ্য নতুন নয়। ‘হিন্দুত্ব জীবনের পথ’ বলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও বারবার নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে তুলে ধরেছেন সঙ্ঘ-নেতারা। অন্য দিকে বিরোধী দলের নেতাদের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদী মুখে শুধুই উন্নয়নের কথা বললেও সঙ্ঘ পরিবার বিভাজনের রাজনীতি করছে এবং সেটাই সঙ্ঘ-বিজেপির দ্বিমুখী কৌশল। আর তার বিরুদ্ধে একযোগে সুর চড়ালেন তাঁরা। কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি, বিএসপি প্রধান মায়াবতী, জেডিইউ নেতা শরদ যাদব, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির মতো সব বিরোধী নেতাই এ দিন একসুরে বলেন, সংবিধানে কোথাও হিন্দুস্তান শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। ভারতে বসবাসকারী সব নাগরিক ভারতীয়, হিন্দু নন। ভারতের বহু ধর্মের সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই সেখানে ‘হিন্দুস্তান’ শব্দটি সংবিধান প্রণেতারা ব্যবহার করেননি। বিরোধীদের অভিযোগ, দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ করার জন্যই ভাগবত এই মন্তব্য করেছেন।
সঙ্ঘপ্রধানের মন্তব্যকে সমর্থন করে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বলেন, “চিরাচরিত ভাবে ভারতকে হিন্দুস্তান হিসেবে বর্ণনা করা হয়।” বিজেপির অন্য নেতারা অবশ্য এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে তাঁরা যথেষ্টই অস্বস্তিতে। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁদের বক্তব্য, সঙ্ঘপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলা সমীচীন নয়। তার উপরে যখন একই সঙ্গে ‘লোকসভায় জয়ের কৃতিত্ব কোনও এক নেতার নয়’ বলেও মন্তব্য করেছেন ভাগবত। তা-ও এমন সময়ে, যার মাত্র দু’দিন আগে বিজেপির জাতীয় পরিষদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লোকসভা জয়ের কৃতিত্ব দলের নতুন সভাপতি অমিত শাহকে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁকেই ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ শিরোপা দিয়েছেন তিনি। সেই অস্বস্তি কাটাতে আরএসএসের আর এক শীর্ষ নেতা মনমোহন বৈদ্য বলেন, “সরসঙ্ঘচালকের মন্তব্য আদৌ মোদীর বক্তব্যকে খণ্ডন করা নয়। ঘটনাচক্রে মোদীর মন্তব্যের পরেই ভাগবতের বক্তব্য সামনে এসেছে। কিন্তু উভয়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।” তাঁর ব্যাখ্যা, আরএসএস প্রধান বলতে চেয়েছেন, কোনও এক নেতা নন, মানুষ কেন্দ্রে পরিবর্তন চেয়েছিলেন বলেই এই জয় এসেছে।
দলের অনেকেই বুঝতে পারছেন, উন্নয়ন ও হিন্দুত্বের দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে সঙ্ঘ এবং বিজেপি আগামী বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিলেও মূল সমস্যাটা অন্যত্র। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই একাধিক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্ঘের পার্থক্য প্রকট হতে শুরু করেছে। মোদী সরকারের অনেক পদক্ষেপই না-পসন্দ সঙ্ঘের। আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের মাধ্যমে এই অসন্তোষ সরকারের কাছে জানানোও হচ্ছে। এর পাশাপাশি অমিত শাহকে সভাপতি করার পর যে ভাবে সংগঠনের উপরেও নিজের শক্তি বাড়াচ্ছেন মোদী, তাতেও সঙ্ঘের একাংশ ক্ষুণ্ণ। তাঁরা মনে করছে, এর ফলে তাদের প্রাসঙ্গিকতা খর্ব হচ্ছে। বিজেপির এক নেতার কথায়, “সঙ্ঘ যা-ই বলুক, আরএসএসের সঙ্গে মোদীর সংঘাতের সূচনা শুরু হয়েছে। মোদী অবশ্য এখনও পর্যন্ত সকলকে সঙ্গে নিয়েই চলার বার্তা দিচ্ছেন। কিছু দিন আগে রেস কোর্সে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ভাগবতদের সঙ্গে মোদীর নৈশভোজ সেই বার্তারই অঙ্গ।”