Mental Health

বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষই নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন! দাবি হু-র রিপোর্টে, ভারতের অবস্থাও উদ্বেগের, বলছেন মনোবিদেরা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিমারি কালে মানুষের রোজকার জীবনযাত্রা আমূল বদলে গিয়েছে। অনেকেই চাকরি খুইয়েছেন। কাছের মানুষকে হারিয়েছেন। নানা নিরাপত্তাজনিত কারণে বেড়েছে মানসিক চাপ, অবসাদ।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৫৮
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

শরীরে অসুখ হলে যতটা সহজে বলা যায়, মনের অসুখে তা যায় না। মনের গভীরে কোথায় উদ্বেগ-ভয় বাসা বেঁধে রয়েছে, তা বোঝাও সম্ভব নয় কারও মুখ দেখে। অনেক সময় তা বলেও বোঝানো যায় না। ফলে শুশ্রূষার অভাবে সেই উদ্বেগ বা ভয় বাড়তে বাড়তে অবসাদে পরিণত হয়। বা তার চেয়ে আরও বেশি কিছু! গোটা বিশ্ব জুড়েই যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার আরও এক প্রমাণ মিলল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (হু)-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে।

Advertisement

হু-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ নানা রকম স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভোগেন। এই সংক্রান্ত দু’টি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে হু। একটির নাম ‘ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেল্থ টুডে’ এবং দ্বিতীয়টি হল ‘মেন্টাল হেল্থ অ্যাটলাস ২০২৪’। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিমারি কালে মানুষের রোজকার জীবনযাত্রা আমূল বদলে গিয়েছে। অনেকেই চাকরি খুইয়েছেন। কাছের মানুষকে হারিয়েছেন। নানা নিরাপত্তাজনিত কারণে বেড়েছে মানসিক চাপ, অবসাদ। যা এখন কার্যত ‘মহামারি’র আকার নিয়েছে!

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মানুষ ভাল নেই। পরিসংখ্যানগত ভাবে সেটা উঠে এল এখন। কিন্তু আমরা যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি, তাঁরা প্রতিনিয়ত এর আন্দাজ পেয়ে থাকি। খারাপ থাকার বিবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, পারস্পরিক হিংস্রতা এবং অসহিষ্ণুতা আমাদের মানসিক ক্ষতকে আরও গভীর করছে। আমরা কেউ ভাল নেই। কিন্তু এক জন ভাল না-থাকা মানুষ অন্য জনের পাশেও নেই। এটা আমার কাছে একটা গভীর সঙ্কটের বলে মনে হচ্ছে।’’

Advertisement

অনুত্তমার মতে, এই বিদ্বেষ বা হিংস্রতা কেবলমাত্র যুদ্ধ বা সীমান্তনির্ভরই নয়, সমাজমাধ্যমেও এমন কিছু আচরণ দেখা যাচ্ছে, তার থেকেও বোঝা যায়, মানুষ কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। একে অপরকে বিদ্ধ করতে উদ্যত হয়ে উঠছে। মানুষ যত বেশি বিপন্ন বোধ করছে, নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত হচ্ছে, তত যেন আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। অনুত্তমার কথায়, ‘‘আমরা নিজেদের সুরক্ষাবলয় তৈরি করতে গিয়ে আরও অনেক বেশি সম্বলহীন হয়ে পড়ছি। এই আচরণ আমাদের কষ্টের নিবারণ নয়, বরং আরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’

তবে কোভিড-পর্বের আগের পরিস‌ংখ্যানও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। রিপোর্ট বলছে, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় বেশি ভোগেন মূলত ২০-২৯ বছর বয়সিরা। ২০১১ সালের পর থেকে এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। মনের অসুখগুলির মধ্যে সবচেয়ে দেখা যায় উদ্বেগ (অ্যাংজ়াইটি) এবং অবসাদ (ডিপ্রেসিভ ডিজ়অর্ডার)।

অনুত্তমা মনে করেন, যে কোনও মানসিক অসুখের প্রাথমিক উপসর্গ হিসাব উদ্বেগ (অ্যাংজ়াইটি), অবসাদ, ভয় আসতে পারে। তার মানে সেটিই যে আলাদা করে অসুখ, তা না-ও হতে পারে। রোগের তকমা যদি সরিয়েও রাখা হয়, তা হলেও অবসাদ এবং উদ্বেগ মানুষকে আবৃত করে রেখেছে। এ কথা অনস্বীকার্য। অনুত্তমার কথায়, ‘‘উদ্বেগ এবং অবসাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ফারাক আছে। একজন উদ্বিগ্ন মানুষ অনেক বেশি অস্থির এবং অশান্ত হয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। তখনও অবধি তাঁর সমাধান খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস আছে। কিন্তু খুঁজে না পাওয়ার ভয়ও আছে। সে তখনও হাল ছাড়েনি। অবসাদ মানুষকে অনেক বেশি নিষ্ক্রিয় করে তোলে। তখন যেন মনে হতে থাকে, আর কোনও চেষ্টাই কোনও ফল দেবে না। ফলে কিছু করেই কিছু লাভ নেই, এই বোধ তাকে গ্রাস করতে থাকে।’’

হু-এর রিপোর্টে আলাদা করে ভারতের কথা উল্লেখ না থাকলেও, এ দেশের পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগের। মনোবিদেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কোভিড-পর্বে মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, ভারতের প্রায় ২০ কোটি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ২০২০ সালের পর ১৭-২৪ বছর বয়সি ভারতীয়দের মধ্যে প্রতি সাত জনের এক জনকে গ্রাস করেছে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ আর উৎসাহহীনতা।

মনোবিদ রঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক ২০১৫-’১৬ সালে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি’ শুরু করেছিল। তাতেও দেখা গিয়েছিল, দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ ভুগছেন অ্যাংজ়াইটি বা ওসিডি (অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার) জাতীয় সমস্যায় ভোগেন। আবার ১ শতাংশ ‘সিভিয়ার মেন্টাল ডিজ়অর্ডারে’ আক্রান্ত। রঞ্জনের কথায়, ‘‘দেশের জনসংখ্যা যদি ১৪৩ কোটি হয়, তা হলে এক কোটিরও বেশি মানুষ ভুগছেন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিজ়অর্ডার জাতীয় মনোরোগে।’’

অর্থাৎ, সরকারও যে এই সঙ্কট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, তা স্পষ্ট। কিন্তু জনস্বাস্থ্যে তার প্রভাব দেখা যায় না বলেই মত রঞ্জনের। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যা বরাদ্দ হয়, মেরেকেটে তার ১-২ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত।’’

পশ্চিমবঙ্গেও মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামো যথেষ্ট নড়বড়ে বলে মনে করেন রঞ্জন। ওই মনোবিদ বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে মনোবিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোসমাজকর্মীদের সংখ্যা ৮০০-১০০০। রাজ্যে এতগুলো যে মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিতে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার শুশ্রূষার উপযুক্ত পরিকাঠামো রয়েছে। আর মনোরোগের হাসপাতাল রয়েছে সাতটি। তা-ও যথেষ্ট নয়। সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। আরও ক্ষমতা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য আধিকারিকদের হাতে।’’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদেরও মত, মনোরোগীকে সহায়তা দিতে হলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধীনে যে জেলাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্প আছে, তার পরিসর বাড়াতে হবে। যাতে তা দূরতম মানুষটির কাছেও পৌঁছে যেতে পারে। যে কোনও রোগ সারানোর প্রথম ধাপ হল মানুষের মনে আশা জাগানো। অসরকারি যে সব সংগঠন এই ধরনের কাজ সারা ভারত জুড়ে করে চলেছে এবং প্রমাণ করেছে, চিকিৎসায় মানুষ সুস্থ হয়ে যান, তাদের পরিসর আরও বিস্তৃত করাও জরুরি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement