পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি, দিল্লিকে আশ্বাস মস্কোর

গত ষাট বছরে এই প্রথম ইসলামাবাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে মস্কো। পাকিস্তানকে সামরিক হেলিকপ্টার ও বিমান সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। তা নিয়ে ভ্রুকুটি করে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীরা যখন মোদী সরকারের বিদেশনীতির ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করছেন, তখন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ ব্যাপারে বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

(রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমান থেকে) শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৫ ১৮:৫৪
Share:

গত ষাট বছরে এই প্রথম ইসলামাবাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে মস্কো। পাকিস্তানকে সামরিক হেলিকপ্টার ও বিমান সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। তা নিয়ে ভ্রুকুটি করে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীরা যখন মোদী সরকারের বিদেশনীতির ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করছেন, তখন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ ব্যাপারে বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

Advertisement

পাঁচ দিনের ‘অতিশয় সফল’ মস্কো সফর শেষে রাষ্ট্রপতি আজ দেশে ফেরেন। বিমানে সাংবাদিক বৈঠকে তাঁকে পাকিস্তান প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মস্কো-ইসলামাবাদ সামরিক সমঝোতা প্রসঙ্গ কি উত্থাপন করেছেন তিনি? বিদেশ সচিব জয়শঙ্করকে পাশে নিয়ে জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক যারপরনাই মজবুত ও অনন্য। প্রতিরক্ষা ও শক্তি ক্ষেত্রে সমঝোতার প্রশ্নে মস্কো খুবই নির্ভরশীল বন্ধু।’’ অন্য কোনও দেশের সঙ্গে রাশিয়া যদি সম্পর্ক তৈরি করেও তা হলেও তার আঁচ ভারতের ওপর পড়বে না বলেই বার্তা দিতে চান তিনি।

কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যে মার্কিন সফরে গিয়েছেন। দু’দিন বাদে চিন সফরেও যাচ্ছেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটেই রাজ্যসভার কংগ্রেসের উপ-দলনেতা তথা প্রাক্তন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী আনন্দ শর্মা দলীয় তরফে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘‘কূটনীতিতে ভারসাম্য হারাচ্ছে মোদী সরকার। তাই রাশিয়ার মতো বন্ধু দেশও অখুশি। মস্কো যে ভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তুলছে তা উদ্বেগজনক।’’

Advertisement

বিদেশমন্ত্রক জানাচ্ছে, দ্বিপাক্ষিক দৌত্যে নয়াদিল্লি এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে মস্কো। সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিকের কথায়, পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি কিছুটা চাপে রয়েছে। রুশ অর্থনীতি প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বিষয়টিকে সেই প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। সাবেক সোভিয়েত জমানা থেকে ৭০ শতাংশ প্রতিরক্ষা সামগ্রী রাশিয়া থেকে আমদানি করে ভারত। দু’দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনও পদক্ষেপ মস্কো করবে না বলে দিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে।

পুতিনের সঙ্গে প্রণববাবুর বৈঠক তথা মস্কো সফর যে সর্বতো ভাবে সফল ছিল তা আজ রাষ্ট্রপতি বার বার উল্লেখ করেন। আর তাঁর সঙ্গে সফররত কূটনীতিকরা বলেন, আসলে পাকিস্তানের বিষয়টি ক্ষুদ্র বিষয়। আসল ব্যাপার হল, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য রাখল মোদী সরকার। অন্য দিকে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘২০১৪-য় দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যে সমঝোতা হয়েছিল তার বাস্তবায়নের গতিতে নয়াদিল্লি খুশি। প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা ও পরমাণু উৎপাদনে অগ্রগতি হচ্ছে। তা ছাড়া হাইড্রোকার্বন, সার, হীরে, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে ভাল উন্নতি হচ্ছে।’’

মজার ঘটনা হল, সাবেক সোভিয়েত জমানা থেকে নয়াদিল্লি-মস্কো বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আয়তন খুবই কম। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের আয়তনের (৭৬৫ বিলিয়ন ডলার) এক শতাংশও নয়। মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার। আজ সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় রাষ্ট্রপতিকে। জবাবে প্রণববাবু বলেন, ‘‘এটা ঠিকই। নব্বইয়ের দশকে যখন উদারীকরণের পথে হাঁটে ভারত, তখন আসলে অস্থিরতা চলছিল রাশিয়ায়। সেটাও একটা কারণ। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রুশ প্রেসিডেন্ট স্থির করেছেন, আগামী দশ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে ও বিনিয়োগকে ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দেবেন।’’

তবে রাষ্ট্রপতির মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে মোদী সরকারের কূটনীতির একটা পরিবর্তনও দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে রাশিয়া এ বার মহা সমারোহে বিজয় দিবস পালন করে। তাতে রাষ্ট্রপতি ছাড়াও এই প্রথম অংশ নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। কূটনীতিকদের অনেকের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের অবদান কম নয়। দশ লক্ষ ভারতীয় সেনা তাতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া যেমন জয় উদযাপন করছে, নয়াদিল্লি কখনও সে ভাবে ভারতীয়দের অংশীদারিত্বকে উদযাপন করেনি। এ জন্য সাবেক কংগ্রেস সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বই দায়ী ছিল। কিন্তু মোদী সরকার এসে ভারতের সেই অবদানকেই আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে এনে নয়াদিল্লির মর্যাদা বাড়াতে চাইছে। তবে এই আলোচনার রাজনৈতিক জবাব না দিলেও রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘ইতিহাস বিস্মৃত হলে ভুল হবে। এ-ও ভুললে চলবে না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মহাত্মা গাঁধী নিজে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ নেওয়ার ব্যাপারে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার। ভারতীয়দের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি। সেটাই ছিল বির্তকের বিষয়। তবে সময় বদলেছে। বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের বিষয় স্মরণ করে তার উদযাপন আগের সরকারের আমলেও হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে ফ্রান্স ও জার্মানি সফরে গিয়ে বিশ্বযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনার সমাধিতে আমিও গিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন