উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কীর্তনগানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত চর্চার অভাবে তা নিজস্ব গৌরব হারাতে বসেছে। সে কথা মাথায় রেখে শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয় কীর্তন নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে। তাতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন রকমের কীর্তনের কথা তুলে ধরা হয়। শ্রীহট্টের নিজস্ব সম্পদ বলে পরিচিত ঠাটকীর্তনের সঙ্গে উঠে আসে মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, ডিমাসাদের কীর্তনের প্রসঙ্গও।
রামানন্দ রচিত রসতত্ত্ববিলাস গ্রন্থে রয়েছে— ১৪৩১ শকাব্দে শ্রীচৈতন্য তাঁর পিতৃভূমি শ্রীহট্টে আসার পর জ্ঞানবর ও কল্যাণবর নামে দুই অনুগামীকে পূর্ব দিকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা হেড়ম্ব রাজ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। সে সময় হেড়ম্ব রাজ্যের রাজধানী ছিল ডিমাপুর। ওই ধর্মপ্রচার কিছুটা হলেও রাজপরিবারকে প্রভাবিত করেছিল। ডিমাসাদের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণ কীর্তনগানের একটি সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন।
মণিপুরেও বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল। এ জন্য মণিপুরে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মে সংকীর্তন একটি আবশ্যিক অঙ্গ বলে গণ্য হয়। বঙ্গদেশের পাশাপাশি কামতা কামরূপেও বৈষ্ণবধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। এই ধর্ম প্রচারের প্রধান ছিলেন শ্রীমন্ত শঙ্করদেব। তিনি ভক্তিবাদ প্রচার করতে গিয়ে যে ৬টি পথের কথা বলেছেন, তার একটি হল নামকীর্তন। হেড়ম্বের পার্শ্ববর্তী জয়ন্তিয়া রাজ্যেও কীর্তন প্রচলিত ছিল। এই সব তথ্য জানিয়ে লোকগবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় সাধনে কীর্তনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রদায় ও ভাষার সীমানা অতিক্রম করে কীর্তনের সুরে বাঁধা পড়ছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ।’’
তিনি জানান, অঞ্চলভেদে কীর্তনের ধ্রুপদী ঐতিহ্যে যুক্ত হয়েছে কিছু স্থানীয় উপাদান। গায়নরীতিতে জুড়েছে নিজস্ব লোকসঙ্গীতের সুর। এই প্রসঙ্গে ঠাটকীর্তনের কথা টেনে অমলেন্দুবাবু বলেন, ‘‘বরাক উপত্যকা একটি অবরুদ্ধ অঞ্চল। তাই কিছু প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখানে অবিকৃত রয়েছে। এরমধ্যে ঠাটকীর্তন একটি। দেখলে মনে হয়, পুরুষদের নৃত্য। মার্শাল আর্টের সঙ্গে এর যোগ থাকতে পারে।’’ তাঁর যুক্তি, লাঠিখেলা ও অসিচালনার নানা ভঙ্গীর নাম একাঙ্গী ঠাট, দোআঙ্গি ঠাট ইত্যাদি। সম্ভবত এই কলাকৌশলই পরে বৈষ্ণবী অনুষঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন ধরনের কীর্তন রীতির সৃষ্টি করেছে।
রাজন্যশাসিত উত্তর-পূর্বে হিংসা রোধে বৈষ্ণব ধর্মের কি কোনও বিশেষ ভূমিকা ছিল? এই প্রশ্ন তুলে অমলেন্দুবাবু জানান, ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য বলিপ্রথা বন্ধ করেছিলেন বলেই পুরোহিততন্ত্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেঁধেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে সেই ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। সেই সময়েই ত্রিপুরা রাজসভায় অনুদিত হয় হরিভক্তির মহিমা প্রচারক ‘বৃহন্নারদীয় পুরাণ’। হেড়ম্ব রাজ্যেও শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় মহাষ্টমী তিথিতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। তা বন্ধ করে দেন মহারাজ সুরদর্পনারায়ণ। ঠিক তখনই হেড়ম্ব রাজসভায় ভুবনেশ্বর বাচস্পতি অনুবাদ করেন বৃহন্নারদীয় পুরাণ। দু’টি রাজসভায় একই ধরনের ঘটনার পর পুরাণের বঙ্গানুবাদ অমলেন্দুবাবুর কাছে, বৃহত্তর তাৎপর্যের যোটক। তিনি বলেন, ‘‘বৈষ্ণব ধর্ম এবং কীর্তন শুধু ধর্মাচারে সীমাবদ্ধ না-থেকে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।’’
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুবীর করের কথায়, ‘‘নগর সংকীর্তন ছিল এক ধরনের প্রতিবাদ। সে সময়ে সমাজে যে ধরনের বিভেদ ছিল, শ্রীচৈতন্য কীর্তনের মাধ্যমে তা ভাঙতে চেয়েছিলেন। সঙ্কীর্ণতা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করেছিলেন।’’ তিনি জানান, নাগরিক সমাজে কীর্তনের প্রভাব কমে এলেও তৃণমূল স্তরে কীর্তন এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান। এর চর্চা বাড়াতে গেলে সঙ্গীত বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রণালীবদ্ধ ভাবে শিক্ষা দেওয়া দরকার। সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন, কীর্তনের ধারাবাহিক প্রভাব সঙ্গীতের উপর রয়েছে এবং তা আজও বহমান।
সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য আক্ষেপ ব্যক্ত করেন, কীর্তনকে তার মূল অনুষঙ্গ থেকে বাদ দিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠী মাইক বাজানোতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জলদবরণ দেবলস্কর, নিরূপম রাজকুমার, গজেন্দ্রকুমার সিংহ, ননীকুমার সিংহ, মলয় দেব, নীলেন্দু ধর, তুষারকান্তি নাথ, মানবেন্দ্র নাথ, শিবতপন বসু, মনমোহন মিশ্র স্বরূপা ভট্টাচার্য-ও এ দিন কীর্তনের উপর আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রসের গান শোনান কীর্তন-বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ দাস।
কেন তাঁরা কীর্তনের উপর আলোচনার উদ্যোগ নিলেন, শুরুতে তা ব্যাখ্যা করেন সেমিনার কমিটির সভাপতি সমরবিজয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘নতুন প্রজন্মের কাছে একে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে না-পারায় কীর্তনের ঐতিহ্য অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে।’’ শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা আনন্দময়ী ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, এই আলোচনা নতুন ভাবনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।