(বাঁ দিকে) বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
বিপুল ভোটে জিতে বিহারে ক্ষমতায় আসছে এনডিএ জোট। বিজেপি এবং নীতীশ কুমারের জুটির সামনে মাথা তুলতে পারেনি গত বারের ‘ফার্স্ট বয়’ আরজেডি। বরং এক থেকে তারা তিনে নেমে গিয়েছে। মহাগঠবন্ধনে কংগ্রেস এবং বাম দলগুলির অবস্থাও শোচনীয়। এই বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) করেছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশন। মনে করা হয়েছিল, এসআইআর এই ভোটে অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে কি তা হল? প্রাথমিক ফলাফল দেখে মনে করা হচ্ছে, জনসংখ্যার বিচারে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য বিহারে এসআইআর-এর কোনও প্রভাব পড়েনি। সেই কারণেই এনডিএ সেখানে সফল।
গত ২৪ জুন থেকে বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কমিশন চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে ৩০ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ, প্রায় তিন মাস ধরে ভোটার তালিকার ঝাড়াইবাছাই চলেছে। বলা হয়েছিল, ওই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত এবং ভুয়ো ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। বিজেপির বক্তব্য ছিল, ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন ‘অনুপ্রবেশকারী’রা। তবে বিরোধী দলগুলি প্রথম থেকেই এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব ছিল। তাদের অভিযোগ, এসআইআর-এর মাধ্যমে ‘বৈধ’ ভোটারদের বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে। এ ভাবে কেড়ে নেওয়া হবে ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সুপ্রিম কোর্টেও তা নিয়ে একাধিক মামলা হয়েছিল।
বিহারে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮৯ লক্ষ। প্রাথমিক ভাবে এসআইআর-এর খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হলে দেখা যায়, প্রায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম মূল তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ভোটারের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ২৪ লক্ষ। কিন্তু এর পরেও তালিকায় কিছু যোগ-বিয়োগ হয়। খসড়া তালিকা থেকে আরও ৩.৬৬ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ দেয় কমিশন। পাশাপাশিই নতুন করে যোগ করা হয় ২১.৫৩ লক্ষ ভোটারের নাম। ফলে চূড়ান্ত তালিকায় মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ কোটি ৪২ লক্ষ। অর্থাৎ, মৃত এবং ভুয়ো ভোটার মিলে তালিকা থেকে মোট বাদ পড়ে ৪৭ লক্ষ নাম।
পরিসংখ্যান বলছে, ২৪৩টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্র থেকে এসআইআর-এর কারণে সবচেয়ে বেশি নাম বাদ পড়েছে। পটনা, মধুবনি এবং পূর্ব চম্পারণ জেলা বাতিলের তালিকায় শীর্ষে। ‘এসআইআর প্রভাবিত’ এই ১০৬ আসনের মধ্যে অধিকাংশেই জিততে চলেছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট। মহাগঠবন্ধনের দখলে থাকতে পারে হাতেগোনা কয়েকটি আসন। ফলে একটি বিষয় স্পষ্ট, এসআইআর নিয়ে ‘কেন্দ্রের চক্রান্তের’ যে অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা, তা ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলেনি।
এসআইআর-এর বিরুদ্ধে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী বিহারে ১৩০০ কিলোমিটারের ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ১৬ দিন ধরে তা চলেছিল। রাহুলরা ঘুরেছিলেন ২৫টি জেলার ১১০টি বিধানসভা কেন্দ্রে। প্রচার করেছিলেন এই মর্মে যে, বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কমিশন ‘ভোটচুরির’ খেলায় নেমেছে। তাই ভোটের মুখে এসআইআর নিয়ে তৎপরতা। মহাগঠবন্ধনের জোটসঙ্গীরাও ওই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল। এনডিএ-র জয়ের পরে অবশ্য এই পরিসংখ্যানকেই ‘অজুহাত’ করছে বিরোধী জোট। সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব এসআইআর-কে ‘ নির্বাচনী ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘‘বিহারে এসআইআর দিয়ে বিজেপি যে গেম খেলেছে, অন্য কোথাও তা করতে পারবে না। কারণ, ওদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছে। আমরা আর ওদের খেলতে দেব না।’’
বিহারের পর ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, অসম, কেরল এবং পুদুচেরিতে ভোট। পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি ‘এনুমারেশন ফর্ম’ বিলি করার প্রাথমিক পর্যায় অনেকটাই সম্পন্ন। পশ্চিমবঙ্গে আগামী ৯ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে। সেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় রদবদল, নাম তোলা বা বাদ দেওয়ার মতো বিষয়গুলি সম্পন্ন করার সময়সীমা ২০২৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। তার পরেই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে। সেই তালিকা প্রকাশের পরেই ভোট ঘোষণা করা হবে পশ্চিমবঙ্গে।
নির্বাচন কমিশন বাকি রাজ্যগুলিতেও এসআইআর সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে। বিহারের মতো অন্যত্রও কি তা ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকবে? নাকি ‘খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার’ হয়ে উঠবে বাংলা, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে?