ব্রিগেড সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সলতেটা অনেক দিন ধরেই পাকানো হচ্ছিল। দেশজোড়া বিরোধী ঐক্যের ছবিটা সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে স্পষ্ট করে প্রথম বারের জন্য তুলে ধরল যে সমাবেশ, সেই সমাবেশ সলতেটায় শিখার সঞ্চারও করল এ বার। আর তার সুবাদেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জাতীয় রাজনীতির আলোয়।
তৃণমূলের যাত্রাপথে অধিকাংশ সময়টাতেই জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাসঙ্গিক থেকেছেন। বরাবরই তিনি দিল্লিতে গুরুত্ব পেয়েছেন। কিন্তু গুরুত্বটা পেয়েছেন এক জন গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক নেত্রী হিসেবেই। জাতীয় স্তরের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেনি দেশের রাজনৈতিক শিবির এর আগে কখনও। শনিবার ব্রিগেডের সমাবেশ বুঝিয়ে দিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এখনও সে ভাবে শিকড় গাড়তে পারেনি বাংলার বাইরে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই রয়ে গিয়েছে বাংলার শাসক দলটা। কিন্তু দলের নেত্রী যেন এখন সে পরিচয়ের অনেক ঊর্ধ্বে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের দিকে নিরন্তর চ্যালেঞ্জ ছোড়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন যিনি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গোটা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরকেই যে তিনি পথ দেখাতে পারেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে খুব একটা মতপার্থক্য নেই।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই বিরোধী শিবির ছত্রভঙ্গ, শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দাপুটে বিজেপির জমানায় ওই দশায় পড়ে থাকলে যে অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়ে যাবে, তা বিরোধী দলগুলোর বুঝতে সময় লাগেনি। সেই থেকেই কাছে আসা শুরু। তবে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধী শক্তির জোট বাঁধা শুরু গত বছরখানেক ধরে। সেই প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকেই সক্রিয় থেকেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও সংসদে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে ফ্লোর কো-অর্ডিনেশনে গিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চকে ঘিরে ফেলা, কখনও সংসদ কক্ষের বাইরে একের পর এক নজরকাড়া ধর্নার আয়োজন— মোদী বিরোধিতার পরিসরে তৃণমূল এ ভাবেই সামনের সারিতে থেকেছে বরাবর। এর পরে কখনও অখিলেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও কেজরীবালের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কখনও নোটবন্দির বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র কণ্ঠস্বর অন্য সব প্রতিবাদকে ম্লান করে দিয়েছে, কখনও এনআরসি ইস্যুতে বিজেপির সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর দল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরন্তর সঙ্ঘাতই ক্রমশ তাঁকে বিরোধী শিবিরের চোখের মণি করে তুলছিল সংশয় নেই। শনিবার কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি করা মঞ্চ যে ভাবে বিরোধী ঐক্যের রূপরেখাটাকে গোটা দেশের সামনে প্রথম বারের জন্য স্পষ্ট করে তুলল, তাতে এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গেলেন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম চালকের আসনে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে দেশের প্রায় দু’ডজন রাজনৈতিক নক্ষত্র শনিবার হাজির হলেন ব্রিগেডের মঞ্চে। দেবেগৌড়া, শরদ পওয়ার, ফারুখ আবদুল্লা, শরদ যাদব, চন্দ্রবাবু নায়ডুদের মতো বর্ষীয়াণ এবং পোড় খাওয়া রাজনীতিকরা নিজেদের ভাষণে দ্বিধাহীন ভাবে মান্যতা দিয়ে দিলেন বিরোধী রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রগণ্য অবস্থানকে। কেউ বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই বিরোধী ঐক্যের এই চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী সম্ভব হল। কেউ আবার অকপটে কৃতজ্ঞতা জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদব, জয়ন্ত সিংহ, জিগ্নেশ মেবাণী, হার্দিক পটেলদের মতো তরুণরা আরও একধাপ এগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের প্রতি নিজেদের আস্থার কথা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন ব্রিগেড থেকে।
আরও পড়ুন: আগে ঐক্য, পরে প্রধানমন্ত্রী: গোটা দেশের নজর কেড়ে নিয়ে সমস্বর রামধনু ব্রিগেড
উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সপা সুপ্রিমো অখিলেশ যাদব নিজের রাজ্যে সদ্য নির্বাচনী সমঝোতা করেছেন সেই মায়াবতীর সঙ্গে, যিনি নিজের জন্মদিনের উপহার হিসেবে উত্তরপ্রদেশবাসীর কাছ থেকে একটা প্রতিশ্রুতি চেয়ে নিয়েছেন— পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশ থেকেই নির্বাচিত করার প্রতিশ্রুতি। ‘বুয়া’ মায়াবতীর চাওয়া ওই উপহারের তাৎপর্য কী, তা ‘বাবুয়া’ অখিলেশ খুব ভালই বুঝেছেন। তা সত্ত্বেও ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অখিলেশ এ দিন প্রায় কথা দেওয়া ঢঙে বলে গিয়েছেন, ‘‘বাংলা থেকে যা শুরু হল, গোটা দেশে এ বার তা-ই চলবে।’’ অখিলেশের এই মন্তব্যে মমতার উচ্ছ্বসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ যে রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আরও পড়ুন: শনিবারের ব্রিগেড, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কে, কী বললেন?
শনিবারের ব্রিগেড সমাবেশ বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে কলকাতায় আসা রাজনীতিকরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবেই দেখেন। পটনা সাহিবের বিজেপি সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা তো দিন দুয়েক আগে খোলাখুলিই বলেছিলেন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর আঞ্চলিক নেত্রী নন, তিনি এখন জাতীয় নেত্রী। কিন্তু জাতীয় স্তরের নেত্রী হিসেবে মান্যতা পাওয়ার পথে মমতার সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত কংগ্রেসকে নমনীয় হতে বাধ্য করা।
কংগ্রেসকে ছাড়া বিজেপি বিরোধী সরকার গড়া সম্ভব নয় আর কংগ্রেসকে নিয়ে সরকার গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রী রাহুল গাঁধীই হবেন— এমন ইঙ্গিত বার বার দিতে কংগ্রেস নেতারা খুবই ভালবাসেন। কিন্তু রাহুল গাঁধীকে বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে তিনি যে একেবারেই প্রস্তুত নন, তা বুঝিয়ে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তা নিয়ে মমতা-রাহুলে বা কংগ্রেস-তৃণমূলে ঠান্ডা লড়াই চলেছে। কখনও শরদ পওয়ার সওয়াল করেছেন রাহুলের হয়ে, কখনও কুমারস্বামী মুখ খুলেছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দমেননি। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাউকে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই— এই অবস্থানে অনড় থেকেছেন। দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের ফল কিন্তু মিলল। শনিবারের ব্রিগেড সমাবেশ বুঝিয়ে দিল, বিরোধী জোটের নেতৃত্বের প্রশ্নে মমতা নিজেও কম অগ্রগণ্য নন।
আরও পড়ুন: ব্রিগেডে পরিশুদ্ধ জল পৌঁছতে রাস্তায় দেখা গেল ভ্রাম্যমান এটিএম
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধির উপস্থিতি এ দিন বিরোধী জোটের ছবিটাকে আরও নিরঙ্কুশ করেছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী নিজে হাজির হননি ব্রিগেডে। মমতার সঙ্গে যাঁর দীর্ঘ ব্যক্তিগত সদ্ভাব, সেই সনিয়া গাঁধীও ব্রিগেডে পৌঁছননি। কিন্তু মল্লিকার্জুন খড়্গে এবং অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি ব্রিগেডের মঞ্চে হাজির হয়েছেন। খড়্গের সাফ বার্তা, ‘‘মন মিলুক, না মিলুক, হাত আমাদের মেলাতেই হবে।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃণমূল তুলে ধরতে শুরু করেছে গত কয়েক মাস ধরেই। জাতীয় স্তরে তেমন কোনও প্রস্তাবের অবতারণা এখনও হয়নি। কিন্তু রাহুলের প্রধানমন্ত্রিত্বের যাবতীয় প্রস্তাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার পত্রপাঠ খারিজ করেছেন। তার পরেও রাহুল গাঁধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে প্রতিনিধি পাঠানোয় প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতের মিল হোক বা না হোক, তাঁকে অবজ্ঞা করার জায়গায় এখন কংগ্রেসও নেই। খড়্গে এবং সিঙ্ঘভিকে মঞ্চে বসিয়ে রেখে মমতা এ দিন বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, ভোটের পরে ঠিক করব।’’ সভামঞ্চ থেকে তো নয়ই, সভা শেষে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলন থেকেও খড়্গে সে কথার কোনও স্পষ্ট বিরোধিতা করেননি। উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দেওয়ালের লিখন।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।