New Labour Codes

নয়া চার শ্রমবিধি কার্যকর করে দিল কেন্দ্র! সংসদে পাশ হওয়ার পরে গত পাঁচ বছর ধারাবাহিক প্রশ্নের মুখে পড়ছে এই সংস্কার

কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারমুখী ভাবনা দেখালেও কেন্দ্রের নয়া চার বিধি নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে বিস্তর। এই নয়া চার শ্রমবিধির মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বার্থকে অবহেলা করা হয়েছে বলে বার বার অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ২২:৪৩
Share:

কারখানায় কর্মরত শ্রমিক। — ফাইল চিত্র।

নতুন চার শ্রমবিধি কার্যকর করে দিল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রক জানিয়েছে, শুক্রবার থেকেই চার শ্রমবিধি কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এই চার শ্রমবিধি সংক্রান্ত বিল বেশ কয়েক বছর আগেই পাশ হয়েছে সংসদে। একটি বিল ২০১৯ সালে পাশ হয়। বাকিগুলি পাশ হয় পরের বছর, ২০২০ সালে। এ বার ওই চার শ্রমবিধি কার্যকর করে দিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

Advertisement

২০১৯ সালে পাশ হয়েছিল মজুরিবিধি সংক্রান্ত বিল। তার পরের বছর পাশ হয় শিল্পক্ষেত্রে সম্পর্কবিধি সংক্রান্ত বিল, সামাজিক সুরক্ষাবিধি সংক্রান্ত বিল এবং পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত বিল। ২০২০ সালে ওই তিনটি বিল একপ্রকার বিনা বাধাতেই রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নিয়েছিল কেন্দ্র। ওই সময় সংসদের বাইরে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বিরোধীরা। তখন প্রায় ‘বিরোধীহীন’ রাজ্যসভায় তিনটি শ্রমবিল পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র।

কেন্দ্র আগেই জানিয়েছিল, তারা শ্রমক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য এই শ্রমবিধিগুলি চালু করছে। সেই লক্ষ্যে অনেক আগেই ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনের মধ্যে ১৫টিকে ‘বর্তমান সময়ে অপ্রাসঙ্গিক’ বলে চিহ্নিত করে বাতিল করে দেয় কেন্দ্র। বাকি ২৯টি শ্রমআইনকে সংস্কার করে নিয়ে আসা হয় চার নতুন শ্রমবিধির আওতায়। তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি শুরু থেকেই এই নয়া শ্রমবিধির বিরোধিতা করে আসছে।

Advertisement

যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, পুরনো দিনের শ্রম আইনগুলিকে যুগোপযোগী করার জন্যই এই সংস্কার করা হয়েছে। শুক্রবার কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, দেশকে আত্মনির্ভর করার জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে শ্রম সংক্রান্ত বিধির আধুনিকীকরণ করে, শ্রমিককল্যাণ এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবেশকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করতেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রের। বিবৃতিতে কেন্দ্র আরও জানিয়েছে, দেশের অনেক শ্রম আইনই স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার ঠিক পর পর (১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এর দশকে) চালু হয়েছিল। তখনকার অর্থনীতি এবং কর্মক্ষেত্রের তুলনায় এখনের পরিস্থিতি অনেক আলাদা।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজমাধ্যমে লেখেন, “আজ আমাদের সরকার চারটি শ্রমবিধি কার্যকর করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এটি সবচেয়ে ব্যাপক এবং প্রগতিশীল শ্রম-ভিত্তিক সংস্কারগুলির মধ্যে একটি। এটি দেশের শ্রমিকদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে। এটি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রকেও আরও সহজ করে তুলবে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সমাজমাধ্যমে দাবি করেছেন, এই শ্রমবিধি দেশের শ্রম আইনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংস্কার।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারমুখী ভাবনা দেখালেও কেন্দ্রের নয়া চার বিধি নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে বিস্তর। এই নয়া চার শ্রমবিধির মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বার্থকে অবহেলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যেমন নতুন কেন্দ্রীয় বিধি অনুসারে, কোনও সংস্থার ৩০০-র কম কর্মী থাকলে, তারা সরকারকে না জানিয়েই ব্যবসাপত্র উঠিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে কোনও সংস্থা বা কারখানা সাময়িক ভাবে বা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দিতে হলে সরকারি নিয়মনীতির আর তোয়াক্কা করতে হবে না মালিকপক্ষকে।

পাশাপাশি, কর্মীদের কাজের নিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। পুরনো নিয়মে কোনও সংস্থায় ন্যূনতম ১০০ জন কর্মী থাকলেই, ওই সংস্থায় ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ কার্যকর হত। এ বার নয়াবিধিতে ন্যূনতম কর্মীসংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ বলতে বোঝায়, কোনও কর্মীকে কাজ থেকে বরখাস্ত বা সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করার সময় নোটিস ধরানো। নয়া বিধিতে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ কার্যকর হওয়ার জন্য সংস্থার ন্যূনতম কর্মীসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মালিকপক্ষই সুবিধা পাবে বলে অভিযোগ উঠছে। এর ফলে কোনও কারণ ছাড়াই কর্মীদের বরখাস্ত বা সাসপেন্ড করার সুযোগ আরও বেড়ে গেল বলে মনে করছেন অনেকে।

তবে এই শ্রমবিধি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। কারণ শ্রম সংক্রান্ত বিষয় সংবিধানের যুগ্মতালিকার মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ, এই বিষয়ে কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য উভয় সরকারই আইন তৈরি করতে পারে। ফলে নয়া শ্রমবিধি কোনও রাজ্যে চালু করতে গেলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের ছাড়পত্রের প্রয়োজন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার শুরু থেকে এই চার শ্রমবিধিরই বিরোধিতা করে আসছে। অন্য বেশ কিছু রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও চার শ্রমবিধির কিছুতে আপত্তি জানিয়েছে।

যেমন, মজুরিবিধিতে পশ্চিমবঙ্গের পাশপাশি আপত্তি রয়েছে লক্ষদ্বীপের। সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধিতে আপত্তি রয়েছে তামিলনাড়ুর। পেশাগত সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি এবং শিল্পক্ষেত্রে সম্পর্কবিধিতে শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আপত্তি জানিয়ে আসছিল দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার। বর্তমানে দিল্লিতে বিজেপি সরকার গঠনের পরেও রুল জারি করা হয়নি। শ্রম সংক্রান্ত বিষয় যে যুগ্ম তালিকায় রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির রাজ্য সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।

নয়া চার বিধি কার্যকরের বিষয়ে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবীয় ঘোষণার পরে ঋতব্রত বলেন, “আমাদের দেশে শ্রম সংক্রান্ত বিষয় রয়েছে যুগ্ম তালিকায়। কেন্দ্রের তালিকাতেও নেই, রাজ্য তালিকাতেও নেই। শ্রমকোড পূর্ণাঙ্গ ভাবে কার্যকর করতে গেলে সমস্ত রাজ্যে তার রুল ফ্রেম করতে হবে। অথচ আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকে এই সর্বনাশা শ্রমকোডের বিরোধিতা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই চারটি শ্রমকোডেরই বিরোধিতা করেছে এবং রুল ফ্রেম করেনি। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও রাজ্য আছে, যারা (শ্রমবিধির) সঙ্গে একমত হয়নি। যেখানে সব রাজ্য একমত নয়, সেখানে কেন্দ্র কী ভাবে বলে এটি কার্যকর হল।” তাঁর কথায়, “গোটাটাই শ্রমস্বার্থ বিরোধী। শ্রমজীবী মানুষ বিরোধী। সেই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রকে সহজ করার নামে শ্রমিক শোষণ আরও তীব্র হবে। শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকার কেড়ে নিতে চাইছে।”

বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলিও শুরু থেকে এ বিরোধিতা করে আসছে। শুক্রবার সিটুর সাধারণ সম্পাদক তথা সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য তপন সেন বলেন, “গত ১৩ তারিখেও এই নিয়ে বৈঠক হয়েছিল। ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ দাবি করেছিল, শ্রমকোড বলবৎ করবেন না। তার চেয়ে গত দশ বছর ধরে যে ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্স বকেয়া রয়েছে, তা অনুষ্ঠিত করে সেখানে আলোচনা হোক। কিন্তু এই সরকার ফ্যাসিবাদী মনোভাব নিয়ে চলছে। আমাদের সংঘাতের পথেই যেতে হবে।” একই ভাবে দশ শ্রমিক সংগঠনের এক মিলিত মঞ্চও শুক্রবার এই শ্রমবিধির নিন্দা জানিয়েছে। এই শ্রমবিধিগুলি ‘শ্রমিকবিরোধী’ বলে অভিযোগ তুলেছে তারা। তাদের দাবি, এর ফলে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে নিয়োগদাতা সংস্থাগুলির সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। যদিও আরএসএস-এর শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement