গৈরিক পোশাকের জনসমুদ্র বারাণসীতে। ছবি: এএফপি।
যেন মনে হচ্ছে কুম্ভ শুরু হয়ে গিয়েছে|
কিন্তু সে-তো ২০১৯-এর জানুয়ারি মাসে ইলাহাবাদের সঙ্গমে| কিন্তু বুধবার নাগপঞ্চমীর দিন বারাণসী এক অভূতপূর্ব জনসমুদ্র| লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের উন্নয়নের কথা বলছিলেন, বলছিলেন, নতুন প্রজন্ম নতুন নতুন কর্মসংস্থান আবিষ্কার করছেন, ঠিক তখন এখানে কালভৈরব মন্দির থেকে গোদলিয়া হয়ে বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরে যাচ্ছিলেন লক্ষ লক্ষ যুবক, কালসর্প দোষ কাটাতে!
উগ্র গেরুয়া পোশাক! কপালে রক্ততিলক| খালি পা| অনেকটা আমাদের বাবা তারকনাথের যাত্রার মতো | জেলাশাসক দীপক অগ্রবাল বললেন, ‘‘মঙ্গলবার এসেছিল আড়াই লক্ষ মানুষ| বুধবার দুপুরের মধ্যেই তিন লক্ষ মানুষ এসে গিয়েছে বাইরে থেকে! বিভিন্ন রাজ্য, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, এমনকি রাজস্থান থেকেও এসেছেন বহু মানুষ!’’
কিন্তু নাগপঞ্চমীর দিন উত্তরপ্রদেশে এত হইচই কেন? কী তার ইতিহাস?
আরও পড়ুন: মরণোত্তর শৌর্যচক্র পাচ্ছেন জম্মু ও কাশ্মীরের জওয়ান ঔরঙ্গজেব
শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে প্রতি বছর হয় এই উৎসব| মহাদেব গলায় যে সাপ জড়িয়ে রেখেছেন এ হল তার পুজো! হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক ডায়না বলছেন, ভারতে সাপের পুজো প্রাক বৈদিক ঘটনা| বর্ষাকালে সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে| মানুষ তাকে ভয় পায়| প্রাণীকে পুজো করার সময় থেকেই সাপের পুজো|
বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মদর্শনের অধ্যাপক দীননাথ মিশ্র বলেন, শিবপুরাণে এ নাগপঞ্চমীর কাহিনি আছে | সমুদ্রমন্থনের জন্য দেবতা এবং রাক্ষস যৌথ ভাবে মহাদেবের কাছ থেকে লম্বা দড়ি চাইলে তিনি তাঁর সাপকে দেন| শিবের সাপ বাসুকী, তার বোন মা মনসা|
শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালতে বাঙালিও পিছিয়ে নেই| রামকৃষ্ণ মিশনের অতিথিশালায় তিলধারণের স্থান নেই। রাজ্যের প্রায় সব জেলার মানুষই হাজির|
নাগপঞ্চমীর বারাণসী জল-কাদা-বৃষ্টিকেও তোয়াক্কা করছে না! ছবি: এএফপি।
অন্ধ বিশ্বাসই বলুন আর কুসংস্কার, মানুষ এখানে দেখতে যাচ্ছে নবপুরার এক বিশাল গভীর কুয়ো| প্রচলিত বিশ্বাস, এটাই নরক যাওয়ার রাস্তা| এখানে পুজো দিলে শাপমুক্তি হবে!
আরও পড়ুন: সাড়ে তিন কিমি তেরঙায় মুড়ে দিন বদলের রং
তবে গৈরিক পোশাকের যুব বাহিনী অনেকে ম্যাটাডর, অনেকে অটোরিকশাও ভাড়া করে আসছে| বৃষ্টিতে ভিজে অনেকে হাঁটছেও| যে বলিউডি সঙ্গীত চালিয়েছে তা ভয়াবহ| কর্ণভেদী। দুই সাহেব-মেমসাহেবকে দেখলাম, দুই কানে আঙুল গুঁজে পথ হাঁটছেন| যুবকেরা অনেকেই গঞ্জিকা সেবন করতে করতে চলেছে। শিবঠাকুরের আপন দেশে এ ব্যাপারে সামাজিক উদারতা চোখে পড়ার মতো। কালভৈরবের মন্দিরে তো মদের দোকান থেকে কেনা ছোট হুইস্কির বোতল ফল-ফুলের ঝুড়িতে দেওয়ার রেওয়াজ আছে!
তবে বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রধান অধিকর্তা বিশ্বনাথ সিংহ বললেন, এ বার এই উৎসবে মেয়েদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতো! উত্তরপ্রদেশের নানা গ্রাম থেকে দল বেঁধে বাস ভাড়া করে নানা বয়সের মেয়েরা এসেছে| বিশ্বনাথ সিংহ নয়ডাবাসী| এখানে তিন বছরের পোস্টিং। তাঁর মতে, এ-ও এক ধরনের নারীশক্তির অভ্যুত্থান!
এ সবের মধ্যে আর একটা চোখে পড়ার মতো ঘটনা— সন্ধ্যে ৬টায় জ্ঞানব্যাপি মসজিদে তো বটেই, কাছেই মণিকর্ণিকা ঘাটের কাছেই রাস্তার ওপর এক বিশাল মসজিদে নমাজ পড়া চলছে, আর তখনই দ্বারভাঙা রাজার তৈরি নীলকণ্ঠ মন্দিরে চলছে রুদ্রাভিষেকের মন্ত্রোচ্চারণ! রাস্তায় সরকার লাগিয়ে দিয়েছে বিশাল বিশাল আধুনিক এলসিডি পর্দা! সেখানে শিবের সারা দিনের আরতি, মঙ্গলারতি থেকে শৃঙ্গার বা সপ্তর্ষি আরতি— একের পর এক দেখিয়ে চলেছে!
আরও পড়ুন: হিংসার স্থান নেই, বললেন রাষ্ট্রপতি
রিকশা থেকে দেখলাম, মসজিদের সামনে এক চায়ের দোকানে সরু বেঞ্চিতে বসে এক খয়েরি ছুঁচোল দাড়ি, টুপি পরিহিত বৃদ্ধ তাঁর কোলের নাতিকে মহাদেবের পর্দাজোড়া আরতি দেখাচ্ছেন. জেলাশাসক বললেন, ‘‘না, কোনও টেনশন নেই। এখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান!
ভাবছিলাম, মানুষে মানুষে ভেদ নেই! তা হলে দাঙ্গাফাসাদটা বাধায় কে বলুন তো?