Pprotest in the Parliament

সংসদে কেন আমরা এই পথ নিতে বাধ্য হলাম

২০ সেপ্টেম্বর সংসদে যা হল, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অন্ধকার একটা পর্ব। ওই দিনটাকে আমরা ‘ব্ল্যাক সানডে’ বলছি। কী ঘটেছিল ব্ল্যাক সানডে-তে? আমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

Advertisement

ডেরেক ও’ব্রায়েন

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:০৮
Share:

ডেপুটি চেয়ারম্যানের চেয়ারের সামনে ডেরেক ও’ব্রায়েন। ছবি: পিটিআই।

আজ কলম হাতে নিয়েছি ভারতের যুব সমাজের উদ্দেশে। ভারতের যুব সমাজ, আপনারা শুনছেন? এটা আপনাদের জন্য। এই সংসদ আপনাদের। এই গণতন্ত্র আপনাদের। এ দেশের কৃষকরা আপনাদের। ভবিষ্যতটাও আপনাদের। আমি জানি আপনারা হয়তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কলেজ যাচ্ছেন, কেউ কর্মস্থলে যাচ্ছেন, কেউ হয়তো বন্ধু-বান্ধবকে সময় দিচ্ছেন, কেউ পরিবারকে নিয়ে ভাবছেন। গত দশ দিনে ভারতের সংসদে কী কী হয়ে গিয়েছে, বিশদে সে সবের খোঁজ হয়তো আপনারা রাখতে পারেননি। সেই কারণেই আপনাদের জানাচ্ছি।

Advertisement

এই কয়েকটা দিনে আমরা দেখলাম, সংসদে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। ২০ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ রবিবার সংসদে যা হল, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অন্ধকার একটা পর্ব। ওই দিনটাকে আমরা ‘ব্ল্যাক সানডে’ বলছি। কী ঘটেছিল ব্ল্যাক সানডে-তে? আমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

সে দিন সকাল সাড়ে ৯টায় দুটো কৃষি সংক্রান্ত বিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল রাজ্যসভায়। আলোচনার জন্য সাড়ে তিন ঘণ্টা বরাদ্দ হয়েছিল, সাড়ে ৯টা থেকে ১টা। আলোচনা শেষ হওয়ার পরেই বিল পাশ হয়। তবে পাশ হওয়ার আগে যে কোনও সদস্য বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন। বিল নিয়ে আরও আরও বিশদ আলোচনার জন্য বা বিলটির বিভিন্ন দিক আরও নিখুঁত ভাবে খতিয়ে দেখার জন্যই বিভিন্ন বিলকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়। আমি এবং আমার মতো বিরোধী বেঞ্চে থাকা আরও অনেক সাংসদই ওই বিলকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিলাম। কারণ ওই বিল নিখুঁত ভাবে খতিয়ে দেখার সুযোগই হয়নি। প্রথমে অধ্যাদেশ হিসেবে ওইগুলো জারি করা হয়েছিল। আপনারা সবাই জানেন, অধ্যাদেশ হল আপৎকালীন ভিত্তিতে জারি করা কোনও অস্থায়ী আইন। পরে সেগুলোকে সংসদে পাশ করিয়ে স্থায়ী করা হয়, অর্থাৎ আইনে পরিণত করা হয়। কিন্তু অধ্যাদেশ যে হেতু আপৎকালীন ভিত্তিতে জারি হয়, সে হেতু স্বাভাবিক কারণেই অধ্যাদেশের সব দিক খুব ভাল ভাবে খতিয়ে দেখা থাকে না। তাই স্থায়ী আইনে পরিণত করার আগে তার নানা দিক খতিয়ে দেখা জরুরি। সেই কারণেই আমরা ওই কৃষি বিলকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রস্তাব খারিজ করা হল এবং একটা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খারিজ করা হল।

Advertisement

এই পদ্ধতিটা আপনাদের একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন, কোনও বিল নিয়ে আলোচনা শেষ হল। এর পরে বিরোধী বেঞ্চ থেকে কোনও সাংসদ বললেন বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। বিল সিলেক্ট কমিটিতে যাওয়া উচিত কি না, তা নির্ধারণ করতে তখন ভোট নেওয়া হয়। চেয়ারে যিনি রয়েছে, তিনি প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ বলে ভোট দিতে বলেন। সাংসদরা ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলে নিজেদের মতামত জানান। চেয়ার তখন জানায় ধ্বনিভোটে সরকার পক্ষই জয়ী হল। এটাই রীতি। কিন্তু বিরোধী বেঞ্চ থেকে যদি ‘ডিভিশন’ বা প্রকৃত ভোটাভুটি চাওয়া হয় অর্থাৎ বিরোধী বেঞ্চের এক জনও যদি ‘ডিভিশন চান’, তা হলে সত্যিকারের ভোট নিতে চেয়ার বাধ্য।

কৃষি বিলকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ধ্বনিভোট নিয়েই যখন চেয়ারে আসীন রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারপার্সন হরিবংশ নারায়ণ সিংহ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলতে চাইছিলেন, তখন আমরা ডিভিশন চাই। আমি একা নই, বিরোধী বেঞ্চ থেকে আমরা অন্তত ৪ জন সাংসদ ডিভিশন চাই। অতএব ডেপুটি চেয়ারপার্সন ভোট নিতে বাধ্য ছিলেন। বৈদ্যুতিন ভোটগ্রহণ ব্যবস্থা সে দিন কাজ করছিল না। সুতরাং ভোট হলে কাগজের স্লিপে তা নিতে হত। সেটাই হোক, আমরা সেটাই চাইছিলাম। কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে আমাদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। ডিভিশনের দাবি ওঠা সত্ত্বেও রাজ্যসভায় সে দিন ভোটাভুটি হতে দেওয়া হল না। একটা সংসদীয় রীতিনীতি, প্রথা ও পরম্পরার অত্যন্ত গুরুতর উল্লঙ্ঘন। এটা কেমন জানেন? এটা হল সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধরে এনে এক জায়গায় দাঁড় করানো হল। তার পরে তার পেটের মধ্যে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া হল! খুন করে ফেলা হল!

এই রকম চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ চলবে, সংসদীয় রীতিনীতি ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হবে আর বিরোধীরা বসে বসে ললিপপ চুষবে, এটা কি কেউ আশা করতে পারে! আমরা সেই আশাতীত এবং অবিশ্বাস্য ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। আমরা সবাই প্রতিবাদ করেছি। সরকার ওই বিল পাশ করানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল না। যে সব দল সরকারে না থেকেও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের পক্ষেই সংসদে ভোট দেয়, তেমন কয়েকটি দলও রবিবার চেয়েছিল, কৃষি বিল সিলেক্ট কমিটিতে যাক। ওড়িশার বিজেডি বা তেলঙ্গানার টিআরএস তাদের অন্যতম। যাঁরা বিরোধিতা করেন না, তাঁরাও আজ বিরোধিতা করছেন, এটা দেখে সরকার পক্ষ সম্ভবত ঘাবড়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই ভোটাভুটিতে কিছুতেই যেতে চাইল না। ধ্বনিভোটকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হল।

যাঁরা আজ বলছেন, বিরোধীরা গণতন্ত্রকে সম্মান করে না, তাঁরা আগে বলুন, ওই ব্ল্যাক সানডে-তে কি সরকার গণতন্ত্রকে সম্মান করছিল? সংসদীয় নিয়মের প্রতি কি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখানো হয়েছিল? যে ঘটনা সে দিন রাজ্যসভায় ঘটানো হল, তাতে প্রতিবাদ হতে বাধ্য। পুরো বিরোধী পক্ষ ওয়েলে নেমে পড়েছিল। হ্যাঁ, কয়েক জন সাংসদ একটা মাইক্রোফোনও সে সময়ে ভেঙে ফেলেন। কিন্তু যে রকম চরম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে প্রতিবাদের মাত্রাও চরমে পৌঁছবেই। মাইক্রোফোন ভেঙে ফেলা নিয়ে বিলাপ করা হচ্ছে! বিজেপি তো আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিচ্ছে। প্রতিবাদ তো হবেই। তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে।

আরও পড়ুন: কৃষক ইস্যুতে তপ্ত টুইট-যুদ্ধ, সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তোপ ধনখড়ের

আমিও সেই প্রতিবাদের অংশ ছিলাম। কিন্তু আমি রুলবুক ছিঁড়ে ফেলেছি বলে যা রটানো হচ্ছে, তা পুরো মিথ্যা। আমি রুলবুকটা তুলে ধরে দেখাচ্ছিলাম, কিন্তু ছিঁড়িনি। ডেরেক ও’ব্রায়েন বই ছিঁড়তে পারে না। ডেরেকের বাবা ৪৫ বছর একটা প্রকাশনা সংস্থা চালিয়েছেন, ডেরেক বই ছিঁড়তে পারে না। রাজ্যসভা টিভিতে সেই ঘটনাক্রম দেখানো হয়নি। তাই আসলে কী ঘটেছিল, তা কেউ দেখতে পাননি। আর বিজেপি সেই সুযোগ নিয়ে বাইরে সংবাদমাধ্যমকে বলল, ডেরেক রুলবুক ছিঁড়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: তিন দাবিতে রাজ্যসভা বয়কট বিরোধীদের, ধর্না তুললেন সাংসদরা

তবে এর সঙ্গেই আরও একটা কথা বলতে চাইব। রুলবুক আমি সে দিন ছিঁড়িনি ঠিকই, কিন্তু যদি ছিঁড়ে ফেলতাম, তা হলেও আমার কোনও আফসোস থাকত না। কোন রুলটা সেখানে রয়েছে? কোনও রুলই তো নেই! রুলবুক ছিঁড়লে কিসের আফসোস! তাই কাল যদি রুলবুক ছেঁড়ার দরকার হয়, আমি এ বার সত্যিই ছিঁড়ে ফেলব। আপনারা মনে রাখবেন, কেউ না লড়ুক, আমরা লড়েছিলাম। ভারতের কৃষকের জন্য লড়েছিলাম। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়েছিলাম। ভারতীয় সংসদের জন্য লড়েছিলাম। মনে রাখবেন, কৃষকের জন্য এর চেয়েও অনেক বেশি কঠিন লড়াই লড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৬ দিন অনশন করে তিনি কৃষকের অধিকার রক্ষা করেছিলেন। তাঁর সৈনিক হয়ে আজ আমরা যদি সংসদে কৃষকের হয়ে না লড়ি, আর কে লড়বে!

লেখক: রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন