নরমে-গরমে চিনকে পাশে রাখতে আপাতত বেজিং সফর নয় মোদীর

চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আবেগে না-ভেসে সতর্ক হয়ে পা ফেলার কথাই ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে বেজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়টিতে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে তাঁর সরকার। আজ চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, চলতি মাসের শেষে পঞ্চশীলের ষাট বছর উদযাপন হবে বেজিংয়ে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০৩:২০
Share:

চিনের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সুষমা স্বরাজ। ছবি: এএফপি।

চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আবেগে না-ভেসে সতর্ক হয়ে পা ফেলার কথাই ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে বেজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়টিতে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে তাঁর সরকার। আজ চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, চলতি মাসের শেষে পঞ্চশীলের ষাট বছর উদযাপন হবে বেজিংয়ে। কিন্তু আমন্ত্রণ পেয়েও বেজিং যাচ্ছেন না মোদী। উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। আগামী কয়েক মাসে দু’দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে পাঁচ-ছ’বার বৈঠক হবে বলেও জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক।

Advertisement

ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য শরিক চিন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং চিনে ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে ভারত। যত ভারতীয় পণ্য চিনে রফতানি হয়, তার চেয়ে বহু গুণ আমদানি হয়ে আসে এ দেশে। তাই ও দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষাটা মোদী সরকারের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই যে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে চান তিনি, সে কথা আজ নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আজ একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে মোদী বলেন, “চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে হলে তিনটি বিষয়ে আমাদের জোর দিতে হবে দক্ষতা, মান এবং কাজের গতি।”

আজকের বৈঠকের পর বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মহম্মদ আকবরুদ্দিন জানিয়েছেন, “নির্দিষ্ট কিছু বাণিজ্যিক প্রকল্প নিয়ে সবিস্তার কথা বলেছেন দু’দেশের নেতৃত্ব। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, ভারতের মাটিতে চিনের বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো বিষয়গুলি নিয়েও কথা হয়েছে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চিরকালীন সমস্যাগুলিও খোলাখুলি ভাবে উঠে এসেছে।” অর্থাৎ স্টেপল ভিসা থেকে অরুণাচল, দক্ষিণ চিনা সাগরে বেজিং-এর অতিসক্রিয়তা থেকে সীমান্তে অনুপ্রবেশের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আজ সরব হয়েছেন সুষমা।

Advertisement

রাজনৈতিক সূত্রের খবর, চিন-নীতির প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়ে চলার জন্য মোদী সরকারের ওপর চাপ দিয়ে চলেছে সঙ্ঘ পরিবার। চিনা বিদেশমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে পা দেওয়ার ঠিক আগে আরএসএস মুখপাত্র রাম মাধব একটি নিবন্ধ লিখে চিন সম্পর্কে মোদী সরকারকে সতর্ক করেছেন। রাম মাধবের বক্তব্য, ‘পাকিস্তান নিয়ে ভারতীয় নেতৃত্ব সর্বদা দুশ্চিন্তায় থাকে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বিদেশনীতির প্রশ্নে বেজিং ইসলামাবাদের তুলনায় অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে আরএসএস কর্তা বলেছেন, চিনে সরকারের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ‘সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন’। সে দেশের শাসক কমিউনিস্ট পার্টির ওপর তার প্রভাব সরকারের তুলনায় বেশি।

চিনা নেতৃত্বের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল। কূটনৈতিক শিবিরের একাংশ এ কথাও মনে করেন, আমেরিকার সঙ্গে মোদীর দীর্ঘমেয়াদি শীতলতার কারণেই বেজিং বরাবর বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে মোদীকে। একাধিক বার চিন সফরে গিয়েছেন মোদীও। এই প্রসঙ্গে কিছুটা সতর্ক করে দেওয়ার সুরেই রাম মাধব বলেছেন, ‘ভারতীয় নেতাদের কে ক’বার চিনে গিয়েছেন, ও দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সমীকরণ তৈরির প্রশ্নে সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের কূটনীতিতে ছলাকলার অভাব নেই।’

এই মুহূর্তে সার্ক দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার একটি পরিকল্পনা রচনা করছেন মোদী। পাশাপাশি তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নও মোদীর অগ্রাধিকারে রয়েছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে মোদীর। আগামী মাসেই টোকিও সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় মাইলফলক তৈরির জন্য একযোগে কাজ শুরু করেছে নয়াদিল্লি ও টোকিও। এর পর সেপ্টেম্বরে ওয়াশিটংনে বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠকের দিন ধার্য হচ্ছে মোদীর। এই অবস্থায় চিনের সঙ্গে বাড়তি ঘনিষ্ঠতা তৈরি করাটা মোদীর পক্ষেও সমস্যার।

মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী লোবসাং সানগেকে নিমন্ত্রণ করার বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। আমন্ত্রণ করা হয়েছিল তিব্বত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দোলমা গাইরিকেও। এই ঘটনার পর চিনের গাত্রদাহ আরও বাড়িয়ে তিব্বত সরকারের ওয়েবসাইটে লেখা হয় এই প্রথম অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একাসনে বসার স্বীকৃতি পেল কেন্দ্রীয় তিব্বতি প্রশাসনের মন্ত্রীরা। বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকার নীরব থাকলেও চিনা নেতৃত্ব প্রতিবাদ এবং অভিযোগ জানিয়েছে দিল্লির কাছে। আজকের বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, তিব্বত ও তাইওয়ানের নেতাদের বাড়তি গুরুত্ব এবং স্বীকৃতি দিয়ে চিনের উদ্দেশে কিছুটা কঠোর বার্তাই দিতে চাইছেন মোদী। সন্দেহ নেই এই কাজে সঙ্ঘ পরিবারের ইন্ধন রয়েছে। কারণ তিব্বতের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে আরএসএস।

বাজপেয়ী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ ১৬ বছর আগে চিনকে এক নম্বর শত্রু বলে চিহ্নিত করার পর দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য-সহ সব আলোচনা ভেস্তে যায়।

এ বার যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, বিদেশমন্ত্রীকে সে দিকে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী কাল ওয়াং বৈঠক করবেন মোদীর সঙ্গে। মুখপাত্রের কথায়, “চিন যাতে ভারতে বিনিয়োগ বাড়ায় সে জন্য আমরা চেষ্টা করছি। বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন