মোদীর বাড়ানো হাত ধরতে আজ দিল্লি দরবারে ওবামা

দীর্ঘ ন’বছর তাঁকে কার্যত অচ্ছুত করে রেখেছিল আমেরিকা। সেই নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে বারাক ওবামার বিমান আগামী কাল সকালে ছুঁতে চলেছে নয়াদিল্লির টারম্যাক। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বার প্রজাতন্ত্র দিবসে বিশেষ অতিথি হতে চলেছেন কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ছ’মাস আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কুর্সিতে বসার পর বিদেশনীতির প্রশ্নে একের পর এক মোক্ষম চাল দিতে দেখা গিয়েছে মোদীকে।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৮
Share:

এয়ারফোর্স ওয়ানে উঠছেন ওবামা দম্পতি। শনিবার অ্যান্ড্রু এয়ারফোর্স বেস, ওয়াশিংটনে। ছবি:এপি

দীর্ঘ ন’বছর তাঁকে কার্যত অচ্ছুত করে রেখেছিল আমেরিকা। সেই নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে বারাক ওবামার বিমান আগামী কাল সকালে ছুঁতে চলেছে নয়াদিল্লির টারম্যাক। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বার প্রজাতন্ত্র দিবসে বিশেষ অতিথি হতে চলেছেন কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

Advertisement

ছ’মাস আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কুর্সিতে বসার পর বিদেশনীতির প্রশ্নে একের পর এক মোক্ষম চাল দিতে দেখা গিয়েছে মোদীকে। তারই সাম্প্রতিকতম সংযোজন এই সফর। এ’টি ঐতিহাসিক আখ্যা পেতে চলেছে কি না, তা আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কূটনীতিকদের বক্তব্য, মনমোহন সরকারের শেষ দফায় রীতিমতো আইসিইউ-এ চলে যাওয়া ভারত-মার্কিন সম্পর্ক যে নতুন অক্সিজেন নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে।

আট বছর আগে ডঙ্কা বাজিয়ে ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি হলেও ভারতীয় পরমাণু বাজারে এক নয়া পয়সারও বিনিয়োগ করতে আসেনি মার্কিন সংস্থাগুলি। তৈরি হয়নি একটি নতুন চুল্লিও। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। বরং নিউ ইয়র্কে কর্মরত প্রাক্তন ভারতীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে নিয়ে টানাপড়েনের জেরে সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। ২০১৩-র শেষ ভাগে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাস থেকে সুরক্ষা বলয় সরিয়ে নিয়েছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকার।

Advertisement

সাত মাস আগে ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে মার্কিন সম্পর্ককে দেখেছেন মোদী। সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক যাওয়াই শুধু নয়, ওয়াশিংটনে গিয়ে ওবামার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে প্রাথমিক পথ নির্দেশিকাও তৈরি করেছিলেন এই দুই শীর্ষ নেতা। তবে তাঁর মাস্টার স্ট্রোক নিঃসন্দেহে প্রজাতন্ত্র দিবসের অতিথি হিসেবে ওবামাকে নিমন্ত্রণ করা। কূটনীতিকদের মতে, এই মুহূর্তে ভারত এবং আমেরিকা উভয়েরই প্রয়োজন একে অপরকে। খুচরো বিদেশি বিনিয়োগ থেকে প্রতিরক্ষা সব ক্ষেত্রেই বিদেশি পুঁজিকে স্বাগত জানাচ্ছেন মোদী। বিনিয়োগ-বান্ধব এই পরিস্থিতি ওবামা তথা মার্কিন প্রশাসনের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই কাঙ্ক্ষিত ছিল। পাশাপাশি মোদী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতি নিয়ে এগোতে চাইছেন, যাতে বিদেশের সংস্থাগুলি এসে এখানে কারখানা তৈরি করে। এ ভাবে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো সরকারের লক্ষ্য। নয়াদিল্লি জানে আমেরিকা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে। এই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে আমেরিকার নিজস্ব উন্নত প্রযুক্তির সুফল পেতে পারে ভারত। সে জন্য আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের ফাঁস ঢিলে করে লগ্নির প্রক্রিয়াকে আরও সরল করা হচ্ছে। আমেরিকার জন্যও এই পরিবেশ স্বস্তিদায়ক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তখন মার্কিন লগ্নির পক্ষে ভারত একটি ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

এই সামগ্রিক বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে হৃত সম্পর্ককে আবার নতুন করে সাজাতে চাইছেন মোদী এবং ওবামা।

কাল দুপুরে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ এবং বৈঠক। তার পর দু’দেশের প্রতিনিধি স্তরের বৈঠক। বিদেশ মন্ত্রকের সূত্রের খবর, যে বিষয়গুলি আলোচনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে চলেছে, তা হল ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তির রূপায়ণ, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দশ বছর আগে করা চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, পরিবেশ সংক্রান্ত চুক্তি রূপায়নের জন্য তোড়জোড়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ কৌশল রচনা এবং অবশ্যই শিল্প এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে দু’দেশের সমঝোতা। বেশ কিছু চুক্তি এবং সমঝোতা পত্র সই হতে পারে কাল। পাশাপাশি একটি যৌথ বিবৃতিও ওবামার সফরকালে ঘোষণা করা হবে।

কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, পরমাণু চুক্তি রূপায়ণের প্রশ্নে মোদী নিজেও যথেষ্ট আগ্রহী। এই ক্ষেত্রটি যে একেবারেই নজরের আড়ালে পড়ে রয়েছে, এবং একটি চুল্লি বসাতে পারলে যে বহু লক্ষ ডলারের বিনিয়োগ টানা সম্ভব হবে, এ কথা ভাল করেই জানে মোদী সরকার। আর এই বাস্তবায়নকে সফল করতে ভারত-আমেরিকা পরমাণু ‘কনট্যাক্ট গ্রুপ’-ও তৈরি করা হয়, যারা গত চার মাসে তিন বার বৈঠক করেছে। মূল সমস্যাটি ছিল ভারতের পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন। এই আইনের ফলে পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের দায় নিতে হবে সরবরাহকারী মার্কিন সংস্থাগুলিকে। এই সমস্যার সমাধানে ভারতীয় সরকারি-বেসরকারি বিমা সংস্থার একটি যৌথ বিমা তহবিল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এর পরেও জট রয়েই গিয়েছে। পরমাণু চুল্লি যে হেতু আমেরিকা তৈরি করবে, তাই তারা চাইছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানিকে তাদের নজরদারির আওতায় রাখতে। কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিরা তার বিরোধিতা করে জানিয়েছে, পরমাণু অস্ত্র সম্প্রসারণের বিরোধিতায় নয়াদিল্লির ভূমিকা প্রশ্নাতীত। এমনকী আমেরিকাও এ ব্যাপারে ভারতের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। তার পরে এই নজরদারি অর্থহীন।

এই বাদানুবাদে বিষয়টি কার্যত ঝুলে রয়েছে। কাল মোদী এবং ওবামার বৈঠকটি তাই দু’দেশের পরমাণু সম্পর্কের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পরমাণুই নয়, সামগ্রিক ভাবে শক্তি ক্ষেত্রটি দু’দেশের শীর্ষ আলোচনায় একটি বড় জায়গা পেতে চলেছে।

সন্ত্রাস-বিরোধিতা যে সামগ্রিক-ভাবে আসন্ন বৈঠকের একটি বড় দিক হতে চলেছে তা গত কাল স্পষ্ট করে দিয়েছেন খোদ ওবামাই। ‘জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য’ নিয়ে মুখ খুলে পাকিস্তানের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি। বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা এটিকে শুভ সংকেত বলেই মনে করছেন। ইসলামাবাদের মদতে বেড়ে ওঠা হক্কানি নেটওয়ার্ক এবং জামাত-উদ-দাওয়ার মত জঙ্গি সংগঠনগুলিকে উৎখাত করতে ভারত এবং আমেরিকা একত্রে কতদূর পদক্ষেপ করবে, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে কাল। তবে সরকারি ভাবে ঘোষণা না করলেও এ ব্যাপারে যে দুই শীর্ষ নেতা বেশ কিছু যৌথ পদক্ষেপ করবেন, এমন ইঙ্গিত মিলেছে। ওবামার সফর শেষ হলেই মার্কিন স্বরাষ্ট্রসচিব জে জনসনের সঙ্গে সন্ত্রাস-বিরোধী আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের ওয়াশিংটনে যাওয়ার কথা আগামী মাসে।

সর্বোপরি বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতির জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস থাকবে দু’পক্ষেরই। এই মুহূর্তে দু’দেশের মোট পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ৬১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যাতে এই পরিমাণ দ্বিগুণ করা যায়, তার পথ সন্ধান করবেন দু’দেশের বাণিজ্য কর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন