তেল-ঘি-মশলা বাদ রাখুন

পেট ফাঁপা, অম্বল, খাওয়ার পরে চোঁয়া ঢেকুরের সমস্যা লেগেই থাকে নিয়মিত। সঙ্গে রয়েছে বদহজম। কী ভাবে রেহাই পাবেন এই অসুখ থেকে, কী করলে এড়ানো যায় এমন সমস্যা বা এর থেকে পরবর্তীতে আর কী কী রোগ হতে পারে, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকপেট ফাঁপা, অম্বল, খাওয়ার পরে চোঁয়া ঢেকুরের সমস্যা লেগেই থাকে নিয়মিত। সঙ্গে রয়েছে বদহজম। কী ভাবে রেহাই পাবেন এই অসুখ থেকে, কী করলে এড়ানো যায় এমন সমস্যা বা এর থেকে পরবর্তীতে আর কী কী রোগ হতে পারে, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

Advertisement

শঙ্খ সেন

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০২:৩৮
Share:

পরীক্ষা: নিজের চেম্বারে চিকিৎসক শঙ্খ সেন। বিশ্বরূপ বসাক

প্রশ্ন: গ্যাস, অম্বল তা থেকে বুক ব্যথা— এ ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকেন অনেকে। কী কারণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে?

Advertisement

উত্তর: এ ধরনের রোগের উপসর্গ বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। অম্বল বা অ্যাডিস কী ভাবে হয়, সেটা জানা দরকার। আসলে খাবার হজম করার জন্য পাকস্থলিতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ক্ষরিত হয়। তা অতিরিক্ত ক্ষরিত হলে বা পাকস্থলীতে জমে থাকলে তাকে অম্বল বা ‘অ্যাসিডিটি’ বলে থাকি। সময়ে খাবার না খেলে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড জমে সমস্যা তৈরি হয়। কেন না আমরা জানি, নরম জায়গায় অ্যাসিড লাগলে ছ্যাঁকা লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক তেমনই পেটে ক্ষরিত অম্ল থেকে পেট জ্বালা হয়। অনেক সময় বুক জ্বালা করে। পেটের অ্যাসিড ওই সব ক্ষেত্রে অনেক সময় গলা পর্যন্ত ওঠে। তাকে গ্যাস্ট্রো ইসোফেগিয়াল রিফ্ল্যাক্স ডিজ়িস বলে। অনেক সময় আমরা বলি টক-জল উঠে আসছে। সে কারণে খাবার পর আধঘণ্টা বসে বা ঘোরাঘুরি করতে বলা হয়। কেন না বিছানায় শোওয়া অবস্থায় থাকলে পেটের অ্যাসিড বুকের দিকে উঠে আসবে। বারবার অ্যাসিডের সমস্যা থেকে ধীরে ধীরে গ্যাসট্রিক আলসার হতে পারে।

Advertisement

প্রশ্ন: পেটে গ্যাসের সমস্যা হওয়া আসলে কী?

উত্তর: খাদ্যনালীর, পাকস্থলী, অন্ত্রে হজমের প্রক্রিয়া চলে। যা খাদ্যের শোষণ বলে পরিচিত। অগ্নাশয়, যকৃৎ, গল ব্লাডার থেকে যে উৎসেচক ক্ষরিত হয়, তা ঠিক মতো হজম করায় সাহায্য করে। পরিমিত উৎসেচক রস ক্ষরণ প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বহাইড্রেটের আত্তিকরণ ঘটে। খাদ্যের অপাচ্য অংশ মল আকারে শরীরের বাইরে বার হয়ে যায়। অনেক সময় এই উৎসেচকের ক্ষরণে হেরফের ঘটে। পর্যাপ্ত উৎসেচক ক্ষরিত না হলে, কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাটের খাদ্যনালীতে শোষণ ঠিক মতো না হলে ‘ম্যাল অ্যাবজর্বশন সিনড্রোম’ হয়ে হজমে বিঘ্ন ঘটে। তাতে গ্যাস হয়। গলব্লাডারের দোষে, যকৃতের বা অগ্ন্যাশয়ের দোষে তা ঘটে। পেট ফুলে ওঠে, ভারী হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন: পেটে অ্যাসিড বেড়ে যায় কেন?

উত্তর: সে কথাটাই বলছিলাম। অনেক সময় আমরা বলি যে বারবার খাওয়া কেন জরুরি? খাবার হজম করাতে পেটে যে অ্যাসিড ক্ষরণ হয়, সঠিক সময় খাবার না খেলে তা পাকস্থলীতে জমে ক্ষতি করতে থাকে। ক্ষিদেও পায়। অনেক ক্ষেত্রে বলতে শোনা যায়, পেটের জন্য মাথা ধরেছে। কথাটা ঠিক নয়। অম্বল, গ্যাসের সঙ্গে মাথা ধরার সরাসরি যোগ নেই। তা উচ্চ রক্তচাপ বা মাইগ্রেনের কারণে হতে পারে। অনেক সময় বুকে হৃদপিন্ডের কাছেও ব্যথা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গ্যাস মাথায় ওঠে না। হৃদপিন্ডের ব্যথাকে এ কারণে অনেক সময় গ্যাস বলে ভুল করে রোগীর চিকিৎসা যথাযথ করা হয় না। তাই হৃদপিন্ডের সমস্যা হলে অনেকে গ্যাসের সমস্যা বলে ভুল করে। তাই ইসিজি করে দেখা দরকার।

প্রশ্ন: কোষ্ঠকাঠিন্য কী ?

উত্তর: পাচিত খাবার পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে নেমে অপাচ্য অংশ শরীর থেকে বার হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে কোষ্ঠকাঠিন্য ঘটে। সেটা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে প্রকাশ পায়। তাতে মল ঠিক মতো হয় না। বৃহদন্ত্রে বা কোলনে মল গেলে তা বার হওয়ার নির্দিষ্ট সময় বা ‘ট্রানজিট’ থাকে। সেই সময়ের পরেও অনেক ক্ষেত্রে পেট পরিষ্কার হতে চায় না। তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। অনেকের আবার দ্রুততার সঙ্গে পেট সাফ হয়। সে ক্ষেত্রে ডায়েরিয়া বা আমাশয়ের উপসর্গ থাকতে পারে।

প্রশ্ন: এ ধরনের সমস্যা দূর করতে কী করবে? কী ধরনের খাবার খাবে?

উত্তর: অ্যাসিড যাতে বেশি না হয় সে জন্য সময় মতো বারবার অল্প করে খেতে হবে। তাতে পাকস্থলীতে খাবার পাচনের জন্য ক্ষরিত হওয়া হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড কাজে লাগবে। অ্যাসিডে লেবু, মৌসম্বির মতো রসালো ফল খেলে সমস্যা বাড়বে। বেশি তেল, ঝাল, মশাল যুক্ত খাবার না খাওয়া বা কম খাওয়াই ভাল। তাই বারবার অল্প করে খাওয়াটা অভ্যাস করা দরকার। অ্যাসিড হলে প্রয়োজনে তরল অ্যান্টাসিড খাবেন। সমস্যা বেশি হলে চিকিৎসককে দেখাবেন। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে শাক, আনাজ, ফল খাবেন। জল পর্যাপ্ত খেতে হবে।

প্রশ্ন: ভাত বা মুড়ি, চিড়ে কোনটা খাবেন গ্যাস, অম্বলের রোগীরা?

উত্তর: রুটি তথা গমের জিনিস অনেকের সহ্য হয় না। ভাত, চিড়ে, মুড়ি তাঁদের সহ্য হয়। সাধারণ ভাবে দেখা গিয়েছে, গমের খাবারের চেয়ে চালের খাবারে সমস্যা কম হয়।

প্রশ্ন: দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার থেকে কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: কথাটা ঠিকই যে অনেকের দুধ বা দুধের জিনিস খেলে গ্যাস-অম্বলের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে দই খাওয়া পেটের পক্ষে বা হজমের পক্ষে সব সময়ই ভাল। বাড়িতে পাতা টক দই হলে আরও ভাল। দইয়ের মধ্যে ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া থাকে। তা হজমে সাহায্য করায়। তাই হজমে যাঁদের সমস্যা, তাঁরা দুধ বাদ দিয়ে দই খেতে পারেন। দুধের গুণাগুণ যা, সে সব দইতেও পাবেন।

প্রশ্ন: অনেকে হুটহাট করে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। সেটা কতটা নিরাপদ?

উত্তর: অম্বল, বুক জ্বালা, পেট ব্যথা হলে তরল অ্যান্টাসিড খেতে পারে। তা দোকান থেকে কেনা যেতেই পারে। সমস্যা নেই। তাতে উপকারই হবে। তবে প্যান্টোপ্রাজ়ল, অমিপ্রাজ়ল গ্রুপের ওষুধ খুশি মতো খাবেন না। এগুলো প্রোটোন পাম্প ইনহেবিটর হিসেবে কাজ করে। শরীরে অ্যাসিড তৈরি করতে বাধা দেয়। স্বাভাবিক অ্যাসিড তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ হলেও হজমে সমস্যা হবে। তাই যাঁদের বেশি অম্বল, গ্যাস হয়, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শেই ওই জাতীয় ওষুধ খাবেন। কেন না চিকিৎসকের কথা মেনে এগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাওয়া যেতে পারে। বদলে অনির্দিষ্ট সময় ধরে লাগাতার তা খাওয়া ঠিক নয়। তাতে হজমের সমস্যা ফের হবে। অনেক সময় টাইফয়েডের মতো জটিল রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

প্রশ্ন: বাচ্চা, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফাস্ট ফুড খাওয়ার চল বেশি। তাতে কি সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: হ্যাঁ, তেল, ঘি, মশলা জাতীয় খাবার খেলে সমস্যা তো হবেই। সে সব যত কম খাওয়া যায় ভাল। প্যানক্রিয়াস বা পাকস্থলী থেকে হজমের জন্য যে অম্ল বা উৎসেচকগুলো একজন মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষরিত হয়। তা কতটা খাবার হজমে সহায়তা করতে পারে, তার সীমা রয়েছে। তার বাইরে খাবার খেলে সমস্যা তো হবেই। বিয়ে, অনুষ্ঠান বাড়িতে বেশি খেলে তাই সমস্যা হয়।

প্রশ্ন: গ্যাস, অম্বলের মতো সমস্যা বা হজমে কোনও সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে কি চিকিৎসকের কাছে যাবেন?

উত্তর: এমনি দোকান থেকে তরল অ্যান্টাসিড কিনে খাওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ খেয়ে দেখা যাচ্ছে সমস্যা মিটল। আবার ওষুধ বন্ধ করলেই সমস্যা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা করানো দরকার। ডায়েট কন্ট্রোলের পরেও যদি সেই সমস্যা হয় তা হলে অল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি, রক্তের লিভার ফাংশন টেস্ট করাতে হতে পারে। মল দ্বারে রক্ত বার হলে সতর্ক হতে হবে। চিকিৎসককে দেখিয়ে প্রকটোস্কোপি বা কোলনস্কোপি করাতে হবে।

প্রশ্ন: শিশুদের ক্ষেত্রে কী কোনও আলাদা সমস্যা রয়েছে?

উত্তর: বাচ্চাদের ভাইরাল ফিভারের মতো ভাইরাল গ্যাসট্রাইটিস হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়। বেশি করে জল, আনাজ, ফল এ ধরনের খাবার খাবে। দুধ থেকে অনেক সময় ডায়েরিয়া হয় শিশুদের। তখন তা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ অনেকের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement