ছবি : সংগৃহীত।
রথের মেলায় গোটা বাংলা উৎসবে মাতে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার পরে সেই উন্মাদনা যে আরও বেশি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু জগন্নাথের রথের দড়িতে প্রথম টানটি পড়বে সেই শ্রীক্ষেত্র পুরীতেই। তবে এগোবে দুনিয়ার বাকি রথের চাকা। রথযাত্রার সঙ্গে জুড়ে থাকা সব ব্যাপারেই তাই পুরী অনুসরণীয়। এমনকি, রথের দিনের খাবারের ব্যাপারেও!
রথের খাওয়াদাওয়া বললে বাঙালি যতই জিলিপি-পাঁপড়ভাজার কথা ভাবুক, শ্রীক্ষেত্রে কিন্তু রথে জিলিপি বা পাঁপড়ভাজা কোনওটিই খাওয়া হয় না। তবে তার বদলে যা খাওয়া হয়, তা যথেষ্ট সুস্বাদু এবং লোভনীয়ও।
আসলে প্রতিটি রাজ্যেরই নিজস্ব কিছু বিশেষ উৎসব আর তার বিশেষ খাওয়াদাওয়া থাকে। বাঙালির যেমন দুর্গাপুজো, পয়লা বৈশাখে খাওয়া হয় শুক্তো, ঘন্ট, পোলাও, পাতুরি, কষা মাংস, পায়েস ইত্যাদি। ওই সময়ে বাংলার মানুষজন, সে তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন ঐতিহ্যের টানে শিকড়ের খাবারে ফিরে যেতে ভালবাসেন। এমনকি, রেস্তরাঁ, খাবারের অ্যাপও সেই আবেগ বোঝে। যার জন্য দিকে দিকে সেই সময়ে চালু হয় বাঙালির খাবারের উদ্যাপন। ঠিক তেমনই ওড়িশার রথযাত্রা উৎসবে দিকে দিকে বোলবোলাও বাড়ে বিশেষ কিছু খাবার-দাবারের।
১। খাজা
খাজাকে বলা হয় জগন্নাথ মন্দিরের সুখিলা বা শুকনো প্রসাদ। যা জগন্নাথের ৫৬ ভোগের একটি। তবে খাজা শুধু ভোগ নয়, খাবার হিসাবেও লোভনীয়। বাংলা যেমন দই-রসগোল্লা নিয়ে গর্ব করে, ওড়িশা নির্দ্বিধায় ঢাক পেটাতে পারে তাদের খাজার ব্যাপারে। রসে ভেজা অথচ মুচমুচে ভাজা ময়দার মিষ্টি এই রাজ্যে যে নেই তা নয়, তবে পুরীর মতো পরতে পরতে খুলে আসা খাস্তা খাজা অন্যত্র পাওয়া যায় না। হয়তো সে জন্যই কেউ পুরী যাচ্ছেন শুনলেই খাজার আবদার করে বসেন পরিচিতেরা। সেই খাজা যে পুরীর সবচেয়ে বড় উৎসব রথযাত্রার দিনেও জমিয়ে খাওয়া হবে, তা তো স্বাভাবিক। রথের মুচমুচে রসালো খাবার হিসাবে জিলিপির সঙ্গেও টক্কর দিতে পারে ওড়িশার এই মিষ্টি।
২। ডালমা
ক্রিসমাসে যদি বাড়িতে কেক খাওয়া হয়, ইদে বিরিয়ানি, তবে রথে পুরীর খাওয়ার বাড়িতে বানিয়ে নিতেই বা আটকাচ্ছে কে! ডালমাও জগন্নাথের ছাপ্পান্ন ভোগের একটি। নানা রকমের ডাল, শাকসব্জি এবং সুস্বাদু মশলা দিয়ে কষিয়ে রাঁধা হয় ডালমা। যাকে আদর করে ওড়িশার মানুষ ডাকেন ‘সকল ডালের মা’! রথের দিন ওড়িশার রেস্তরাঁ থেকে শুরু করে গেরস্ত বাড়ির হেঁশেল— সর্বত্রই রাঁধা হয় ডালমা।
৩। খিচুড়ি
এর জন্য অবিশ্যি পুরীর দিকে না তাকালেও চলে। রথের দিন খিচুড়ি খাওয়ার চল, শুধু পুরী কেন বাংলাতেও রয়েছে। যে সব এলাকায় রথ বেরোয়, সেখানে জগন্নাথের ভোগের খিচুড়ি বাড়ি বাড়ি বিতরণের ব্যবস্থাও থাকে অনেক জায়গায়। তবে ভোগের খিচুড়ি না পেলে বাড়িতেই বানিয়ে নেওয়া যায়। এমনিতেও রথযাত্রা হয় ভরা বর্ষায়। বৃষ্টিমুখর রথের দিন দুপুরের মেনুতে থাকতেই পারে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, গোল গোল মোটা আলু ভাজা আর পাঁচমিশালি তরকারি! সঙ্গে চাটনি পায়েস থাকলে তো কথাই নেই!
৪। রসবালি
নাম যেমন সুন্দর, এই মিষ্টি খেতেও স্বর্গীয়। স্বাদ কেমন? বোঝাতে গেলে বাংলার মিষ্টি দিয়ে কিছুটা বোঝানো যেতে পারে। রাবড়ির মধ্যে যদি রসহীন ছানার জিলিপি ডুবিয়ে খাওয়া হয়, অনেকটা এর মতো স্বাদ মিলতে পারে। কিন্তু রসবালি যিনি খেয়েছেন, তিনিই জানেন এই মিষ্টি শুধু স্বাদে নয়, এর হালকা এলাচের গন্ধেও মাতিয়ে দিতে পারে। ওড়িশার রথযাত্রার খাদ্যসম্ভারে এই মিষ্টি থাকবে না, তা হতেই পারে না!
৫। জগন্নাথ দেবের প্রিয় পোড়া পিঠে
ওড়িশার মানুষ যেমন নানা রকমের মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন, তেমনই তাঁদের আরাধ্য দেবতা জগন্নাথেরও পছন্দের খাবার মিষ্টি। খাজা, পরমান্ন, রসবালির মতো মিষ্টি তো রয়েছেই। তবে তার মধ্যেও জগন্নাথের প্রিয় মিষ্টি হল পোড়া পিঠে। অন্য মিষ্টি তাঁর দৈনিক ভোগ থেকে বাদ পড়লেও পড়তে পারে, কিন্তু পোড়া পিঠে থাকতেই হবে। জগন্নাথের রথযাত্রার দিনে তাই ওড়িশার মানুষও খান পোড়া পিঠে। গুড় নারকেল, রস, চালের গুঁড়ো, বিউলির ডাল, এলাচ, ইত্যাদি দিয়ে বানানো হয় রথযাত্রার এই সুস্বাদু খাবার।
৬। মালপোয়া
এটি এ রাজ্যেও সমান জনপ্রিয়। রাধা-কৃষ্ণ হোন বা গোপাল অথবা জগন্নাথের ভোগে মালপোয়া সাজিয়ে দেন বাঙালিরাও। পুরীর মন্দিরের ছাপ্পান্ন ভোগের একটি এই মালপোয়াও। তবে ওড়িশার মালপোয়া একটু অন্যরকম। সুজি, ময়দা, মৌরি, মরিচের পাশাপাশি জগন্নাথের ভোগের মিষ্টিতে পড়ে দুধ, এলাচ এবং কলা। সেই সব কিছু দিয়ে মন্ড বানিয়ে, তা থেকে লেচি কেটে ঘিয়ে ভেজে ফেলা হয় চিনির রসে। রথের দিনে পুরীর প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই মালপোয়া পাওয়া যায়।
৭। পাখালা ভাত
পাখালা ভাত হল ওড়িশার এক ঐতিহ্যবাহী খাবার। যা জগন্নাথের মহাপ্রসাদ হিসাবেও দেওয়া হয়। জগন্নাথ ভক্তদের বিশ্বাস এই ভাতও তাঁদের আরাধ্য দেবতার অতি প্রিয় খাবারের একটি। এ জন্য পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে বছরে একটি দিন পাখালা দিবসও পালন করা হয়। পাখালা ভাত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, দই পাখালা, মিঠা পাখালা, জল পাখালা, সুবাস পাখালা, চুপুড়া পাখালা, ঘি পাখালা ইত্যাদি। তবে এই ভাত যেমনই হোক, তার মূল উপকরণ হিসাবে রাত ভর জলে ভেজানো পান্তা ভাত থাকবেই। সেই ভাতকে কখনও আদা, জিরে, লেবু দিয়ে মাখা হয়, তো কখনও মাখা দই দিয়ে। ঘি, নুন, আদা, ভাজা জিরে দিয়েও মাখা হয় পাখালা। আবার কোনওটি মাখা হয় গুড় কিংবা জুঁই ফুল দিয়ে। রথের দিন এই খাবার ওড়িশার ঘরে ঘরে বানানোর চল আছে।