গত কয়েক বছর শহরে মারাত্মক ভাবে ডেঙ্গি ছড়িয়েছিল। এ বছর কী সেই সম্ভাবনা রয়েছে?
উ: একবার ডেঙ্গি হলে সাধারণত পরের কয়েক বছর সেই রোগ সংক্রমণের একটা সম্ভাবনা থাকে। কারণ, এটা মনে রাখতে হবে ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী মশার ডিম থেকে যে মশাগুলো জন্মাবে সেগুলো সমস্তই ডেঙ্গির বাহক হবে। তা ছাড়া ডেঙ্গি শহর এলাকার রোগ। সাধারণত পরিষ্কার জলে ডেঙ্গির বাহক মশা ডিম পাড়ে। শহরে, বিশেষ করে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে বিভিন্ন ভাবে পরিষ্কার জল জমে থাকে। তাই ডেঙ্গি মশার জন্ম এবং রোগ ছড়ানোর পক্ষে আদর্শ পরিবেশ পায়।
বিভিন্ন ধরনের ডেঙ্গি রোগের কথা বলা হয়। সেগুলো কী কী?
ডেঙ্গি সাধারণত চার ধরনের হয়। আমাদের এখানে ‘টাইপ ওয়ান’-টাই বেশি দেখা যায়। তার সঙ্গে ‘টাইপ টু’ বা ‘টাইপ থ্রি’ হলে সেগুলো মারাত্মক হতে পারে। এই রোগের প্রকোপ যখন দেখা দেয়, তখন সাধারণত এক ধরণের জীবাণুই বেশি লক্ষ করা যায়। ডেঙ্গির বাহক ইডিশ ইজিপ্টাই মশা। এই মশা পরিষ্কার জলে জন্মায়। ডেঙ্গি আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে ডেঙ্গির জীবাণু মশার দেহে যায়। মশার খাদ্যনালীতে জীবাণু বংশ বৃদ্ধি করে। মশার খাদ্যনালী থেকে জীবাণু মশার ডিমেও সঞ্চারিত হয়। সেই মশা যে ডিম দেয় এবং তা থেকে যে মশা জন্মায় সেগুলো ডেঙ্গির জীবাণু বহন করে। এ ধরনের মশা সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু যায়।
সাধারণত মশা একবার কামড়ালে জীবাণু সংক্রমণ হয় না। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন মশা বারবার কামড়ানোর সুযোগ পায়। এবং তখনই ডেঙ্গির জীবাণু সংক্রামিত হয়।
রোগ প্রতিরোধ কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
গত বছর যেহেতু ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি ছিল, সে কারণে এ বছর আগাম ব্যবস্থা তো নিতেই হবে। মূলত তিনটি ভাগে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসনিক স্তরে, চিকিৎসকদের স্তরে এবং সাধারণ বাসিন্দাদের আরও সচেতন করে।
কোথাও যাতে জল জমে না থাকে বা জমা জলে মশার বংশবিস্তার না হয় তা প্রশাসন তথা পুরসভার মতো স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে নজরে রাখতে হবে। তাঁদের তরফে নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই করতে হবে। মশার লার্ভা, ডিম নষ্ট করতে স্প্রে করতে হবে। প্রশাসনের তরফে বাসিন্দাদের সচেতন করতে হবে। কোনও কর্মসূচি নেওয়া হলে মঞ্চ তৈরি করে সেখানে লোকের জমায়েত করে তা প্রচার করতে হবে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েও প্রচার করতে হবে।
চিকিৎসকদেরও সচেতনতা প্রচারে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। চিকিৎসকদের মানুষ গুরুত্ব দেন। তাঁদের কথা মন দিয়ে শোনেন। তাই মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে তাঁদের।
পাশাপাশি সাধারণ বাসিন্দাদেরও সচেতন হয়ে রোগ প্রতিরোধে অংশ নিতে হবে। বাড়ির আশেপাশে কোথাও যাতে জল জমে না থাকে, পরিবারের লোকদেরই তা দেখতে হবে। বাসিন্দারা নিজেরা সচেতন হলে তবেই ডেঙ্গি প্রতিরোধে সাফল্য আসবে।
ডেঙ্গির উপসর্গগুলো কী কী?
জ্বর। মাথাব্যথা। সঙ্গে গা হাত পা ব্যথা, বিশেষ করে হাঁটু, কনুইয়ের মতো জায়গায় ব্যথা করা। জয়েন্ট পেন বা অস্থিসন্ধিগুলোতে যন্ত্রণা ও বমি ভাব। পেটের অসুখও হয়।
উপসর্গ দেখা দিলে রোগী বা তাঁদের পরিবারের লোকেরা কী করবেন?
চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। সব ক্ষেত্রে যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন তেমন ব্যাপার নেই। জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া অন্য কোনও জ্বরের ওষুধ না খাওয়া উচিৎ। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
কী কী সতর্কতা নিলে ডেঙ্গি প্রতিরোধ সম্ভব হবে
১) সকলের ক্ষেত্রেই মশারি টাঙিয়ে শোয়া বাধ্যতামূলক। দিনের বেলাতেও ঘুমোনোর সময় মশারি টাঙাতে হবে।
২) ডেঙ্গির মশা ভোরে এবং সন্ধ্যায় কামড়ায়। ওই সময়ে শরীর ঢাকা পোশাক পড়া দরকার।
৩) বাড়ির ভিতরে এবং আশেপাশে জমা জল পরিষ্কার করতে হবে।
রোগাক্রান্ত হলে কী করতে হবে?
১) জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি।
২) চিকিৎসক পরামর্শ দিলেই হাসপাতালে ভর্তি হোন।
৩) বেশি করে জল খেতে হবে।
৪) বাড়িতে থাকলেও বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
৫) রক্ত চাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা দরকার।
৬) নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে প্লেটলেট কমছে কি না খেয়াল রাখা জরুরি।
৭) প্লেটলেট নির্দিষ্ট সীমার নীচে নেমে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্লেটলেট দিতে হবে।
কী করা যাবে না?
১) জ্বর হলে অযথা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া চলবে না।
২) প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া অন্য কোনও জ্বরের ওষুধ একেবারেই খাওয়া চলবে না।
৩) হৃদরোগী ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে জ্বরে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ
শেখর চক্রবর্তী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
সাক্ষাৎকার: সৌমিত্র কুণ্ডু