Different types of luchi and its history

জামাইষষ্ঠীতে বাবাজীবনের পাতে, পালে-পার্বণে যা না হলেই নয়, সেই লুচির সাত কাহন এবং স্বাদ কাহন

বাঙালির কাছে লুচির গল্প করা অনেকটা মায়ের কাছে মাসির গল্প করার মতো! তবু লুচি নিয়ে এমন অনেক গল্পই আছে, যা অনেক বাঙালি জানেন না। যেমন অনেকে জানেন না লুচির নানা প্রকারভেদের কথাও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৫ ০৯:০০
Share:

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

জামাইষষ্ঠীর দিন এ পার বাংলার শাশুড়িরা অন্তত জামাইকে একটু ‘ময়দা’ খাওয়াতে চান। এই ময়দা অবশ্য ইংরেজির ‘অল পার্পস ফ্লাওয়র’ নয়। যা দিয়ে বাকি দুনিয়া কেক, প্যাটিস, পাফ, পেস্ট্রি, কুকিজ় বানিয়ে মাত করে দিচ্ছে। এ পার বাংলার শাশুড়িদের কাছে ময়দা খাওয়ার সোজাসাপটা বাংলা হল— লুচি খাওয়া।

Advertisement

বাঙালির কাছে উৎসব মানেই লুচি। সেই লুচি সাদা টপটপে হয়ে ফুলে গরমাগরম কড়াই থেকে নেমে যখন ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা, মোহনভোগ বা মিহিদানা সহযোগে সামনে হাজির হয় কিংবা যদি কালোজিরে ফোড়ন দেওয়া সাদা আলুর তরকারিও সঙ্গে থাকে, তাতেই বাঙালি কাত। জামাই হোন বা বৌমা, স্লিম ফিগার হোন বা স্বাস্থ্য সচেতন, আট হোক বা আশি— পদস্খলন অনিবার্য।

আসলে লুচি দেখলে, শুনলে বা খেলে বাঙালির মস্তিষ্কে আপনা থেকেই সুখী হরমোনের ক্ষরণ হতে শুরু করে। হয়তো লুচি বাঙালিকে উৎসবের কথা মনে পড়ায় বলে। হয়তো প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে তাদের নানা ভাললাগা জড়িয়ে থাকে বলে, হয়তো তাই লুচি ছিঁড়ে মুখে তোলার মুহূর্তে অজান্তে তাদের মনের কোনও এক কোণে শুরু হয়ে যায় সুখস্মৃতির স্লাইড শো!

Advertisement

বাঙালির কাছে লুচির গল্প করা অনেকটা মায়ের কাছে মাসির গল্প করার মতো! ছবি: সংগৃহীত।

লুচি নিয়ে গান, কবিতাও লেখা হয়েছে বাংলায়। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় বাংলা পুরাতনী গান, ‘ওগো লুচি, তোমার মান্য ত্রিভুবনে/ তুমি অরুচির রুচি মুখমিষ্টি সূচি/ খাইয়ে ধন্য জীবন-এ...’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘দোরোখা একাদশী’ কবিতায় বলেছেন পুরুষদের আড়াই দিস্তে লুচি দিয়ে এলাহি একাদশী পালনের কথা।

তাই বাঙালির কাছে লুচির গল্প করা অনেকটা মায়ের কাছে মাসির গল্প করার মতো! তবু লুচি নিয়ে এমন অনেক গল্পই আছে, যা অনেক বাঙালি জানেন না। যেমন অনেকে জানেন না লুচির নানা প্রকারভেদের কথাও।

লুচির ইতিহাস না হক হাজার-দেড় হাজার বছরের পুরনো। বঙ্গে যখন পাল রাজারা রাজত্ব করছেন, সেই সময়ে লুচি খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় পাল যুগের এক চিকিৎসকের গ্রন্থে। তবে তিনি লুচিকে লুচি বলে উল্লেখ করেননি। “গমচূর্ণকে ঘিয়ে মেখে, বেলে, গরম ঘিয়ে ভাজা” সে খাবারের নাম ছিল শষ্কুলী! এটিই লুচির আদি রূপ বলে মনে করেন খাদ্য গবেষকদের একাংশ। যদিও অন্য অংশের মতে বাংলায় ময়দা এনেছিল পর্তুগিজরা। তবে সেই ময়দার খাবার তাঁদের দেশের মতো করে রাঁধতে পারেননি এই অঞ্চলের রাঁধুনিরা। ময়দাকে তেলে ভাজতে গিয়েই তৈরি হয় লুচি।

বাংলা যে লুচিকে আপন করে নেয়, তার আদি রূপের নাম খাস্তা। ছবি: সংগৃহীত।

দ্বিতীয় মতটি মানলে লুচির জন্ম অন্তত ৭০০ বছর পিছিয়ে যাওয়ার কথা। কারণ পর্তুগিজরা ভারতে এসেছিল পনেরো শতকে। অথচ পাল যুগের চিকিৎসক চক্রপানি তাঁর বইয়ে লুচির মতো খাবারের কথা লিখেছেন এগারো শতকে। যুক্তির হিসাবে সে ক্ষেত্রে প্রথম মতটিই টিকে যায়। আর সেই সূত্র ধরে শষ্কুলী আর আজকের লুচির একটা যোগাযোগও পাওয়া যায়।

জানা যায়, পালযুগে শষ্কুলী ছিল তিন প্রকারের— খাস্তা, সাপ্তা এবং পু্রি। এর মধ্যে ময়দায় ময়ান দিয়ে তৈরি হত খাস্তা। সাপ্তায় ময়ান পড়ত না। আটা দিয়ে তৈরি হত পুরি। যা পরবর্তী কালে পুরি নামেই ভারতের অন্য প্রান্তে জনপ্রিয় হয়। বাংলা যে লুচিকে আপন করে নেয়, দেখা যাচ্ছে সেটি আদতে খাস্তারই রূপ।

লুচি তার আদি অকৃত্রিম রূপে বাংলা মাতালেও কালের নিয়মে অনেকেই লুচিকে নানা রূপ দিয়েছেন। উৎসবে, অঞ্চলভেদে লুচি কখনও আকারে বদলেছে কখনও বদল এসেছে বানানোর পদ্ধতিতে।

শোভাবাজার রাজবাড়ির ১১৯ বছরের পুরনো এক বিয়ের মেনু কার্ডে পদ্ম লুচির উল্লেখ মেলে। ছবি: সংগৃহীত।

১। পদ্মলুচির কথাই ধরা যাক। লুচির ভিতরে পাঁঠার মাংস কিংবা ছানার পুর ভরে তাকে পদ্ম ফুলের মতো আকার দিয়ে তৈরি হত পদ্মলুচি। সেই পুর তৈরি হত ভাজা জিরের মশলা আর কাজু কিশমিশ বাটার সঙ্গে মাংস কিংবা ছানাকে কষিয়ে। শোভাবাজার রাজবাড়ির ১১৯ বছরের পুরনো এক বিয়ের মেনু কার্ডে এই লুচির উল্লেখ মেলে। পরে রাজবাড়ির কন্যা কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত তাঁর লেখা ‘পদ্মলুচি, পাদুকাহরণ এবং অন্যান্য’ বইয়েও তাঁদের পরিবারের পুরনো গল্প বলতে গিয়ে লেখেন ওই লুচির কথা। যদিও পদ্মপাতার আকারের লুচি বানানোর চল বহু দিন আগে থেকে মুর্শিদাবাদেও আছে।

২। বগি থালা লুচি: বগি থালা এই যুগে সহজলভ্য না হলেও এক কালে প্রতি পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের মাথা পিছু অন্তত একটি করে কাঁসা বা পিতলের বিশাল মাপের থালা থাকত। যেটি তাঁরা পেতেন বিয়েতে যৌতুক হিসাবে। সেই থালায় ভাত পোলাও ছাড়াও সাজিয়ে দেওয়া যেত অন্তত আরও দশ রকমের ব্যঞ্জন। সে থালার ব্যাস কমপক্ষে হত ৩০-৪০ ইঞ্চি চওড়া। দিনাজপুর জেলার কান্তনগর মন্দিরের ঠাকুরবাড়িতে এক কালে সেই বগি থালার মাপের লুচি বানিয়ে ভোগ দেওয়া হত। তার সঙ্গে থাকত রাবড়ি, ক্ষীর, দই ইত্যাদি। ভক্তেরা সেই প্রসাদ দু হাতে ছিঁড়ে খেতেন। প্রায় একই মাপের লুচি তৈরি হত দিনাজপুরের রাজবাড়িতেও। সেই লুচির নাম আবার ছিল ‘ফুলটাইম’।

৩। হাতিপায়া লুচি: মালদহের সাদুল্লাপুর এলাকাতেও এক ধরনের বড় লুচি পাওয়া যায়। তার নাম হাতিপায়া লুচি। এক একটি লুচির আকারে হাতির পায়ের ছাপের মতোই বড়। তাই অমন নাম। বানানোর পদ্ধতিতে বিশেষ ফারাক নেই। তবে এই লুচি বিক্রি হয় ওজন দরে। তাই ১০০ গ্রাম লুচি কিনলে ভাগে একটি গোটা লুচি না-ও পড়তে পারে।

এক ধরনের বড় লুচি পাওয়া যায়। তার নাম হাতিপায়া লুচি। ছবি: সংগৃহীত।

৪। ক্ষুদ্রতম লুচি: মেদিনীপুর জেলার রাধামোহনপুর স্টেশনের কাছে পলাশী গ্রামে নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়ির ভোগে যে লুচি দেওয়া হত তার এক একটির মাপ নাকি কয়েনের মতো। অর্থাৎ ফুচকার থেকেও ছোট! এমন লিখেছিলেন গবেষক প্রণব রায়। কিন্তু পরে নন্দী বাড়ির তরফে জানানো হয়, তথ্যটি ঠিক নয়।

৫। জামাইভোগ লুচি: এই প্রসঙ্গেই চলে আসে জামাইভোগ লুচির কথা। সেই লুচি খাঁটি কলকাতার। তবে আকারে সাধারণ লুচির থেকে অনেক ছোট। লেখক দীপক দাস লিখছেন, “উত্তর কলকাতায় এক ধরনের লুচি হত। এ লুচি জামাই স্পেশাল। জামাই লুচি ছিঁড়ে খাচ্ছে, রাজধানীর অভিজাতগর্বী উত্তরাঞ্চলের শাশুড়িদের চোখে এমন দৃশ্য নাকি নান্দনিক নয়। তাই তাঁরা এমন মাপের লুচি তৈরি করতেন যা ছোলার ডাল, বাটি চচ্চড়ির সঙ্গে এক গালে পুরে দেওয়া যেত।” সেই লুচির নাম ছিল জামাইভোগ বা জামাই স্পেশ্যাল। যদিও জামাইভোগ লুচি নিয়ে মতান্তর আছে। অন্য একটি মত বলছে, গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সাড়ে তিন থেকে চার ইঞ্চি মাপের ধবধবে সাদা ফুলকো লুচিই হল জামাইভোগ লুচি। এই লুচির গায়ে কোনও তেল-ঘি লেগে থাকবে না। কারণ, ময়ানটি হবে একদম ঠিকঠাক।

জামাই লুচি ছিঁড়ে খাচ্ছে, শাশুড়িদের চোখে এমন দৃশ্য নাকি নান্দনিক নয়! ছবি: সংগৃহীত।

৬। দইয়ের লুচি বা জলে ভাজা লুচি: দইয়ের লুচি ব্যাপারটি সঙ্গে যে খুব পুরনো কোনও ইতিহাস জড়িয়ে আছে তা নয়। বরং এটি তুলনায় আধুনিক। তবে স্বাস্থ্যগুণে বাকি সব ক'টির থেকে এগিয়ে। এই লুচিও ময়দা দিয়েই তৈরি। কিন্তু তেলের বদলে ভাজা হয় জল দিয়ে। ডুবো তেলে ভাজা খাবার খাওয়ায় যাঁদের নিষেধ, যাঁদের লুচি দেখে লোভ সামলাতেই হয়, তাঁরা এই লুচি খেতে পারেন নির্দ্বিধায়। এই লুচির ময়ান ঘি নয়, দই। দই আর সামান্য নুন দিয়ে ভাল ভাবে মাখার পরে অল্প ঘি দিয়ে লুচি বেলে নিতে হবে। তার পরে ফুটন্ত জলে ফেলতে হবে। মিনিট খানেক পরে ভেসে উঠলে তুলে নিয়ে খোলা হাওয়ায় শুকিয়ে মিনিট চারেকের জন্য রাখতে হবে এয়ার ফ্রায়ারে। তা হলেই সাদা ধবধবে স্বাস্থ্যকর ফুলকো লুচি তৈরি।

৭। ‘হজমি’ লুচি: লুচি খেলে কিছু পেটরোগা বাঙালির অম্বল - বদহজম হবে এটা মেনে নিয়েই লুচি খাওয়া। তেমন ক্ষেত্রে লুচি খেলেই বরং হজমির দরকার পড়ে। কিন্তু লুচি নিজেই হজমি হয় কী করে! রহস্য উপাদানে। লুচি খাওয়ার পরে হজমের জন্য যে জোয়ানের খোঁজ পরে, সেই জোয়ানই মিশিয়ে দেওয়া হয় ময়দায়। সঙ্গে ভাজা জিরেও দেন কেউ কেউ। সেটিও হজমে সহায়ক। বাকি প্রক্রিয়া এক।

বাঙালি যতই স্বাস্থ্য সচেতন হোক না কেন, যতই ‘জাঙ্ক’ খাদ্য বর্জন করুক না কেন, সপ্তাহে এক দিন অথবা পালে-পার্বণে লুচির দেখা না পেলে দিন-দুনিয়া কেমন যেন শূন্য লাগে। তাই, কয়েকশো বছর পেরিয়েও লুচির মহিমা অম্লান এ বঙ্গে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement