কলকাতার বাজিবাজারে দামি বাজি কোনগুলি? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
বয়স্ক মানুষদের মুখে শোনা যায়, ‘‘সে ছিল আমাদের সময়ের বাজি। তুবড়ি দেখার মতো, যেমন ফুলকি, তেমন উচ্চতা। বাজি প্রতিযোগিতা ভিড় করে লোকে দেখতে আসত।’’ সময় বদলেছে, বদলেছে বাজি। দোদমা, চকোলেট বোম বহু দিন হল বাতিলের খাতায়। বাড়তে থাকা দূষণ, পরিবেশেপ্রেমীদের উদ্বেগকে মান্যতা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট, পরিবেশ আদালত শুধু সবুজ বাজি ফাটানোয় ছাড়পত্র দিয়েছে। নতুন নিয়ম মেনেই বসছে বাজিবাজার। তৈরি হচ্ছে নতুন রকম বাজি। টালা পার্ক, বেহালা, কালিকাপুর, শহিদ মিনার— শহরের এই চারটি বাজিবাজারে সকাল থেকে রাত চলছে বেচাকেনা। তবে বিক্রি হচ্ছে কোন কোন চমকদার বাজি? দামেই বা শীর্ষে কোনটি?
শহিদ মিনারের বাজি বাজারের একাধিক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নতুন প্রজন্মের পছন্দ রকমারি ‘স্কাই শট’, মানে যে বাজি আকাশে গিয়ে ফাটে। শব্দে এখন লাগাম। দূষণের মাত্রাও কমিয়ে ফেলতে সবুজ বাজি তৈরি হচ্ছে। শব্দের মাত্রা মেপে, আলোর সঙ্গে যথাযথ মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে আকাশবাজি বা শট্স। ক্রিকেট মাঠে আকাশ আলোকিত করা সেই বাজি এই বছর হিট। অন্য বাজিকে পিছনে ফেলে দামেও শীর্ষে। যত তার কেরামতি, ততই দাম বেশি।
১০০ শট্স
শট্সেও রয়েছে বৈচিত্র। তার উপরেই দাম নির্ভর করে। — নিজস্ব চিত্র।
বাজি একটি। কিন্তু তার কারসাজিতেই চোখ থমকাতে বাধ্য। ঢাউস একটা লম্বাটে চোং। গায়ে-গতরেও বেশ ভারী। পলতেয় আগুন দিলেই খেলা শুরু হয়। মুহুর্মুহু আলোর বিস্ফোরণ। চড়চড় করে শব্দ করে আকাশে উঠবে, তবে একটা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলি আলোকরেখা আকাশে উঠে মিলিয়ে যাবে। এক বার নয়, একশো বার। যত ক্ষণ আলোর খেলা চলবে তত ক্ষণ যেন ভিন্ন আবেশ তৈরি হবে, জানালেন কলকাতার শহিদ মিনার চত্বরের এক বাজিবিক্রেতা। নানা কোম্পানির এমন বাজি আছে। তবে খোঁজ করে জানা গেল, এই বাজারে এমন একটি বাজির দাম ৮ হাজার টাকা।
স্কাইশট্স
রকমারি স্কাইশট্স রয়েছে বাজিবাজারে। —নিজস্ব চিত্র।
কোনওটি উঠবে দশতলা বাড়ি ছাড়িয়ে, কোনওটি আবার আলোকবৃষ্টি করবে। স্কাই শট্সে রয়েছে নানা বৈচিত্র। শহিদ মিনারের বাজিবিক্রেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বাজি যদি দেখতে হয় তো এমনটাই। একটি বাজিই খেলা দেখাবে। আসলে এই বাজি খেলার মাঠের আকাশও কাঁপায়। আইপিএল-এ আকাশ আলো করা যে সব বাজি ফাটে, এগুলিও তেমনই। সেই বাজির একটির দাম ৭০০০ টাকা। আবার আকাশে গিয়ে রঙিন আলোর বৃষ্টি করবে, বিশাল ছাতার মতো হয়ে যাবে, এমন বাজিও রয়েছে। এমন একটি বাজির দাম হাজার চারেক।
টু ইন ওয়ান
শট্স বাজির তালিকায় এটিও একটি। বাজিটি মাটিতে প্রথমে ফেটে আলোর সৃষ্টি করে। তার পরে আলোকরেখা চলে যায় আকাশে। আলোর ফুলকিটি উপরে গিয়ে সশব্দে ফেটে আলোকবৃত্তে পরিণত হয়। গুণমানের উপর এর দাম নির্ভর করে। কলকাতার বাজি বাজারে ৪০০-৫০০০ টাকা দামের টু ইন ওয়ান শট রয়েছে।
জঙ্গল সিরিজ
আদতে স্কাই শট্স। তবে নামকরণে রয়েছে বৈচিত্র। এই বাজি নাকি জঙ্গল সিরিজের। চোঙাকৃতি বাজিতে আগুন দিলেই আকাশে উঠে যাবে অনেক উঁচুতে। একসঙ্গে অনেকটা জায়গা জুড়ে আলোর মতো ফাটতে থাকবে। রুপোলি স্পার্কল-এর মতো দ্যুতি ছড়াবে। এমন এক একটি বাজির দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।
১২০ শট
আকাশে এমনই আলো ছড়াবে এই ধরনের বাজি। ছবি:সংগৃহীত।
একটি বাজি থেকে ১২০ রকম আলোর খেলা দেখা যাবে। বাজিতে আগুন দিলেই আকাশে উঠে যাবে। এক এক সেকেন্ড অন্তর আকাশে গিয়ে এক এক রকম আলোর আকৃতি নেবে। বদলাবে রং। কতটা উচ্চতায় উঠছে, কতটা ব্যাস জুড়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, তার উপর নির্ভর করে এই ধরনের বাজির দাম। কলকাতার বাজিবাজারে এগুলির দাম মোটামুটি ২৫০০ টাকা, বলছেন বিক্রেতারা।
শটে আলোকরেখা
শট্স নামে পরিচিত বাজিগুলির কোনওটি যেমন আকাশে বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে আলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনই বেশ কিছু শট্স আছে যেগুলি সরু আলোকরেখায় উপরে উঠে যায়। তার পর সশব্দে ফেটে মিলিয়ে যায়। এগুলি আলোকবৃত্ত রচনা করে না বটে, তবে এর সঙ্গে পুরনো দিনের হাউইয়ের খানিক মিল পাওয়া যায়। যদিও আলোর কারসাজিতে এই ধরনের বাজি রকেট বা হাউইয়ের চেয়ে অনেকটাই আধুনিক। এই ধরনের বাজির দামও বিক্রেতারা বলছেন, ২০০০-২৫০০ টাকা।
আলোর কারসাজি। ছবি: সংগৃহীত।
ডাক
হাঁসের মতো দেখতে বাজি। ছবি: সংগৃহীত।
আতশবাজিটি দেখতে বড়সড় হাঁসের মতো। ওজনও খুব কম নয়। সলতে জ্বালিয়ে দিলে শুরু হয় আলোর খেলা। প্রায় মিনিটখানেক ধরে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে শব্দ করে আলো ছড়িয়ে পড়ে। শহিদ মিনারের বাজিবিক্রেতাদের একজন জানাচ্ছেন, গত দু'বছর ধরে বাজিটি জনপ্রিয় হয়েছে। একটির দাম ১১০০-১৫০০ টাকা।
তুবড়ি
এই ধরনের তুব়ড়িও বিক্রি হচ্ছে বাজিবাজারে। — নিজস্ব চিত্র।
রকমারি কাগজের মোড়কের তুবড়ি যেমন গত কয়েক বছরে জনপ্রিয় হয়েছে, পাশাপাশি মাটির খোলের চিরাচরিত তুবড়ির কদরও রয়েছে। আকারে বেশ বড় এবং ভারী মাটির খোলের তুবড়িও বিক্রি হচ্ছে। মান অনুযায়ী তার দাম। বাজি বিক্রেতারা জানাচ্ছে ৪টি তুবড়ির দাম ১০০০-১৮০০ টাকা। এই ধরনের তুবড়ি অনায়াসে তিনতলা সমান উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। ফুলকিও হয় অনেক বেশি। জ্বলে অনেক ক্ষণ।
বাজি মানে আলোর খেলা। কোনওটি আবার শব্দ, আলো দুই-ই উৎপাদনে সক্ষম। বাজি দেখতে যতই ভাল লাগুক না কেন, তা থেকে যে ধোঁয়া, গ্যাস উৎপন্ন হয়, তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সেই ক্ষতির পরিমাণ কমাতেই বেরিয়াম নামক যৌগটি বাদ পড়েছে সবুজ বাজি থেকে। সাধারণ বাজিতে ব্যবহৃত বেরিয়াম মোনোক্লোরাইড, বেরিয়াম নাইট্রেট ও বেরিয়াম ক্লোরেট আদতে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ আর বায়ুদূষণের কারণ হয়। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সবুজ বাজি থেকে অ্যালুমিনিয়ামের মাত্রাও কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। দূষণ নিয়ে কাজ করা পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’- এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘সবুজ বাজি পুরোপুরি দূষণমুক্ত নয়। তা দূষণের মাত্রা ৩০ শতাংশ কমাতে পারে মাত্র।’’
সবুজ বাজি চেনার উপায়
কোনও বাজি সবুজ কি না, তার স্বীকৃতি দিতে পারে একমাত্র কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (নিরি)। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, প্রতিটি বাজির উপর কেন্দ্রীয় সংস্থা সিএসআইআর-নিরির লোগো এবং কিউআর কোড থাকা বাধ্যতামূলক। বাজির প্যাকেটে থাকা কিউআর কোড নিরি-র অ্যাপ-স্ক্যানারের সাহায্যে স্ক্যান করলেই দেখতে পাওয়ার কথা বাজি সংক্রান্ত নিরি-র ছাড়পত্র। বাজিটি কোন উপাদানে তৈরি, সেটিও সেখানে থাকার কথা।
দূষণ রুখতে বাজি পোড়ানোর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সোমবার কালীপুজো এবং দীপাবলি উৎসবে শুধু রাত ৮টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে সবুজ বাজি পোড়ানো যাবে বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে কলকাতা পুলিশ।