শীত-সঙ্গী অসুখেরা

প্রায় দশ মাস গরম আবহাওয়ায় থাকার পরে মাস দুয়েকের জন্য শীত এলে শরীর ঠিক অভ্যস্ত হতে পারে না। কেউ শ্বাসকষ্টে ভোগেন, কেউ অ্যালার্জি-সর্দিকাশিতে। লিখেছেন চিকিৎসক আমোদ প্রসাদ।শীত থেকে রেহাই পেতে শুকনো কাঠ জ্বেলে আগুন পোহানোর চল আছে। ঘর গরম রাখার জন্য মানুষ জানালা দরজা বন্ধ করে রাখেন। ফলে ঘরের বায়ুর গুণগত মান হ্রাস পায় ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৩২
Share:

পশ্চিমবঙ্গে শীত উপভোগ্য ঋতু। প্যাচপ্যাচে গরম বা একঘেঁয়ে বৃষ্টির থেকে তা মুক্তি দেয়। কিন্তু এই সময়েই আবার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাপমাত্রা কমলে বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে দূষণকারী উপাদানগুলি আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্ষতিকারক গ্যাস, ধোঁয়া, ধূলিকণায় যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা ক্ষতিকর।

Advertisement

শীত থেকে রেহাই পেতে শুকনো কাঠ জ্বেলে আগুন পোহানোর চল আছে। ঘর গরম রাখার জন্য মানুষ জানালা দরজা বন্ধ করে রাখেন। ফলে ঘরের বায়ুর গুণগত মান হ্রাস পায় ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই কারণে মাথা যন্ত্রণা ও শারীরিক অবসন্নতা হতে পারে। তাই নিয়ম করে জানালা দরজা খুলে বিশুদ্ধ বাতাস ঘরে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।

এই সময়ে শিশুদের নিউমোনিয়া হতে পারে। তখন দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। শ্বাসকষ্ট হলে শিশু সারা রাত কান্নাকাটি করবে। শুয়ে থাকতে পারবে না, বসে থাকবে। নেবুলাইজার বা ইনহেলার ব্যবহার করলে শিশু কিছুটা ভালো থাকে। শীতে ঘাম কম হয়। তাই চর্মরোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ত্বক শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতে পারে। সরষের তেল, অলিভ অয়েল বা অন্য ক্রিম ব্যবহার করলে এই সমস্যা থেকে রেহাই মেলে। এই সময়ে মাথায় খুশকি দেখা যায়, পা ফাটে। নিয়মিত মাথায় শ্যাম্পু করুন। গোড়ালি ভাল করে ঘষে ক্রিম লাগিয়ে মোজা পরুন। হালকা গরম জলে স্নান করবেন।

Advertisement

শীতকালে শিশু ঘন ঘন প্রস্রাব করে। ফলে শিশুকে ডায়াপার পরানো উচিত। এ ছাড়া তেল, বিশেষ করে অলিভ অয়েল দিয়ে শিশুকে মালিশ করা যেতে পারে। ঘরের মেঝেতে ম্যাট ব্যবহার করা ভাল। তাতে শিশুর ঠান্ডা কম লাগবে।

ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিকে সরু করে দেয়, ফলে শীতে হাঁপানির টান বাড়ে। আর বাড়ে সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড। শুরুতে গলা ব্যথা করে, গলায় খুশখুশ ভাব ও শুকনো কাশি দেখা দেয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাক দিয়ে অনবরত জল ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে। হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও খাওয়ায় অরুচি দেখা দেয়।

এই অবস্থায় প্যারাসিটামল খাওয়া যায়, গরম জলে ভাপ নেওয়া, গার্গলও খুব উপকারী। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ রোগ আবার আর এক জনের মধ্যেও ছড়ায়। তাই বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা ভাল। শীতে সাইনাস, টনসিল, ব্রঙ্কাইটিস বাড়ে। অসুখের মূল ধাক্কাটা যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপরই। এ সব রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের।

শীতে ঠান্ডা লাগে মূলত ভাইরাসের আক্রমণে। এই রোগের লক্ষণগুলি হল যথাক্রমে বন্ধ নাক, নাক দিয়ে জল পড়া ও ঘ্রাণশক্তি সাময়িক ভাবে কমে যাওয়া, দুর্বলতা, মাথা ধরা, কাশি, নাকের শ্লেষ্মাপর্দা লাল হয়ে ফুলে যাওয়া। তবে শীতের শুরুতে প্রায় প্রতি ঘরে যে রোগটি থাবা বসায় তা হল ফ্লু! এটিও ভাইরাসজনিত রোগ। এর কারণ অর্থোমিক্সো শ্রেণির ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। যা সংক্রামক! বেশ দ্রুততার সঙ্গে শ্বাসনালী পথে ছড়িয়ে পড়ে প্রচুর মানুষকে আক্রান্ত করে। পৃথিবীর সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ১০-২০% প্রতি বছর এই রোগে কষ্ট পান।

এই রোগের লক্ষণ হল— জ্বর বা কাঁপুনি জ্বর, মাথা যন্ত্রণা, গা ম্যাজমেজে ভাব ও পেশী ব্যথা, নাক দিয়ে জল পড়া, নাক বন্ধ লাগা, গলা ব্যথা ও গলা বসে যাওয়া, কাশি ও বুকের মাঝখান ব্যথা হয়, শিশুদের ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা হতে পারে। বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে গলা ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা ও মানসিক বিভ্রান্তিও হতে পারে। গলাব্যথার সঙ্গে ঢোঁক গিলতে অসুবিধা ও গলার গ্ল্যান্ড ফুলতে পারে। রোগ জটিল হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। নিউমোনিয়া বাড়াবাড়ি হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রোগীর প্রাণসংশয় হতে পারে। রোগ বাড়াবাড়ির হওয়ার ঝুঁকি বেশি অ্যাজমা রোগী, বৃদ্ধ, শিশু, নিয়মিত অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খান এমন মানুষ, ডায়াবেটিস-কিডনি-শ্বাসকষ্টের রোগী, গর্ভবতীদের।

এই রোগে গর্ভবতীদের সেপসিস, নিউমোথোরাক্স ও রেসপিরেটরি ফেলিওর হতে পারে। গর্ভপাতের আশঙ্কাও থাকে। প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিতে হবে। এর সঙ্গে পাঁচ বছর অন্তর নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন নিলে শ্বাসকষ্টের রোগীরা উপকৃত হবেন। এই সময় অ্যাজমা রোগও বাড়ে। অ্যাজমার ওষুধ যথাযথ সেবন করতে হবে ও প্রয়োজনীয় ইনহেলার উপযুক্ত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। শীতের উপযুক্ত পোশাকও পরতে হবে। অযথা ঠান্ডা লাগানো যাবে না।

বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে ত্বকে চুলকানি ভাব দেখা দিতে পারে শীতে। তাই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। আবার এই সময়ে অনেকের হাত ও পায়ের আঙুলে রক্ত সরবরাহকারী সূক্ষ্ম ধমনী ও জালিকাগুলি সঙ্কুচিত হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে আক্রান্ত অঙ্গটি প্রথমে সাদা ও পরে নীলচে বর্ণ হয়ে যায়। বেশ যন্ত্রণা হয় আক্রান্ত অঙ্গে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ ২-৬% হলেও অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। হাত পায়ের আঙুল ছাড়া নাক, কানও আক্রান্ত হতে পারে। রিউম্যাটিক ডিজিজ বিশেষত স্ক্লেরোডার্মা থাকলে এর প্রাবল্য অধিক হয়। ঠান্ডায় আঙুলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা থাকলে ধূমপান, কফি পান করাও চলবে না। ত্বকের কিছু ক্রনিক সমস্যা যেমন এগজিমা ও সোরিয়াসিস ঠান্ডার প্রকোপে বাড়তে পারে।

শীতল পরিবেশে দেহের উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য রক্তজালিকার অন্তর্বর্তী ব্যাস কমে যায়। রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়! তাই যারা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা বা হার্টের অসুস্থতায় ভুগছেন এই সময় তাদের অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে ওষুধ খেতে হবে। কারণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলেই হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোকের আশঙ্কা কম থাকবে। শীত থেকে বাঁচতে জামাকাপড় পরতে হবে কয়েকটি লেয়ারে! মোজা, দস্তানা ও টুপি বা মাফলার পরতে হবে। শীতকালে কাজে সহজে ক্লান্তি লাগে না। কিন্তু হৃদযন্ত্রের অসুখের রোগীর ক্ষেত্রে টানা অত্যধিক পরিশ্রম নিরাপদ নয়। মাঝে মধ্যে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করুন। শীত কালে অস্থিসন্ধির ব্যথা বাড়ে! প্রাতঃকালীন আড়ষ্টতাও বৃদ্ধি পায়। ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার সঙ্গে হাঁটাচলা করলে যন্ত্রণা কমে ও রোগের উপশম হয়।

ছবি: প্রণব দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন