হস্টেলবাসী মেয়েদের ভয়ের উৎসমুখগুলি কিন্তু বিবিধ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
সম্প্রতি হিন্দি ওয়েব সিরিজ় ‘খওফ’ কিছু প্রশ্নকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে, যেগুলি নিয়ে সামাজিক আলোচনা সাধারণত হয় না বলাই সঙ্গত। ‘খওফ’ একটি হরর সিরিজ়। তার মূলে রয়েছে অতিপ্রাকৃত শক্তি সংক্রান্ত ভয়। সিরিজ়ের অকুস্থল দিল্লিতে কর্মরতা মেয়েদের একটি হস্টেল এবং মুখ্য কুশীলব এখানকার আবাসিক মেয়েরা। তাদের কেউ কর্মরতা, কেউ আবার ঠিক কী করে বোঝা যায় না। এই হস্টেলেই সিরিজ়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র মধু থাকতে শুরু করে। মধু ছোট শহরের মেয়ে। তার অতীতে একটি ‘দুর্ঘটনা’ রয়েছে। সে কলেজ জীবনের শেষ পর্বে গণধর্ষণের শিকার হয়। সেই ঘটনার স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে। অন্য দিকে, হস্টেলটিরও কিছু ছায়াচ্ছন্ন ইতিহাস রয়েছে। মধু যে ঘরটিতে এসে ওঠে, সেই ঘরের পূর্বতন বাসিন্দা মেয়েটি রহস্যজনক ভাবে মারা যায়। হস্টেলের অন্য বাসিন্দারা ঘরটিকে এড়িয়েই চলে। আবার, হস্টেলের অন্য বাসিন্দাদের অনেকেরই বিবিধ সমস্যা রয়েছে, যার মূলে কাজ করছে ‘ভয়’। সর্বদাই যে এই ভয় অতিপ্রাকৃত উৎসের, তা নয়। রয়েছে অনুসরণকারী বা স্টকারদের নিয়ে সমস্যা, হস্টেলের নিয়ম লঙ্ঘন করে ফেলে কর্তৃপক্ষের কাছে অপদস্থ হওয়ার ভয়, সর্বোপরি রয়েছে আগন্তুকত্বের সমস্যা।
হস্টেলের আবাসিকেরা সকলেই ‘আগন্তুক’। নতুন জনপদে আগন্তুক, নতুন বাসস্থানে আগন্তুক। ফলত তাঁদের মনে যে নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা সংশয় থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে, হস্টেলবাসী মেয়েদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা বা নতুন জনপদে, নতুন কর্মস্থানে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। তার উপর মানুষ মাত্রেই তার জীবনে কোনও না কোনও ‘ট্রমা’ থাকে। সেই সব কিছু মিলিয়েই যে একটা বৃহত্তর ভয় তৈরি হয়, তা সমাজ-মনস্তত্ত্বের গবেষকেরা বলেন। এখন প্রশ্ন, এই ভয় কি শুধুই মেয়েদের? হস্টেলবাসী পুরুষেরা কি এই বিশেষ ভয়টি বা ভয়গুলি থেকে মুক্ত?
সহ-বাসিন্দা মনমতো না হলেও ভয় দানা বাঁধে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রেহানা আখতার (নাম পরিবর্তিত) বাল্যকাল থেকেই বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছেন। তবে হস্টেলবাস শুরু মাধ্যমিক পাশের পর থেকে। তার আগে মফস্সল শহরে নিজেদের বাড়িতেই থাকতেন। পরে জেলা সদরে হস্টেলে আসেন এবং তারও পরে কলকাতায় কলেজে পড়তে এলে ঠাঁই হয় হস্টেলেই। উত্তর কলকাতার সেই হস্টেল এক পুরনো ইমারতে। কলকাতার সঙ্গে রেহানার সেই প্রথম নিবিড় পরিচয়। হস্টেলের সহ-বাসিন্দাদের দিক থেকে বন্ধুত্বের হাত এগিয়ে এলেও মহানগরে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন না রেহানা। তার উপর হস্টেলের বাড়িটির আনাচ-কানাচ, এলোপাথাড়ি অন্ধকার কিছুটা ভয়ের আবহ তৈরি করেছিল। বিশেষ করে রাতে করিডরের প্রান্তে বাথরুমে যেতে গা ছমছম করত। খুব বেশি রাতের নিশুত সময়ে একা সেখানে যেতে প্রায় সব মেয়েই ভয় পেতেন। কিন্তু রেহানা জানিয়েছেন, হস্টেলের বাড়িটিকে ঘিরে কোনও ভৌতিক গুজব ছিল না। বাজারে চলিত একটি ইংরেজি প্রবাদ “এভরি হস্টেল হ্যাজ় ইটস ওন গোস্ট স্টোরি”, অর্থাৎ প্রত্যেক হস্টেলেরই নিজস্ব ভৌতিক কাহিনি রয়েছে— এই ধারণা তাঁদের হস্টেলে না থাকলেও খানিক উদ্ভট পরিবেশ তো ছিলই। রেহানা আরও জানালেন, হস্টেল থেকে বাইরে বেরোনো তেমন সহজ ছিল না। সুপারিন্টেন্ডেন্টের সম্মতি আদায় করতে কালঘাম ছুটে যেত। তার পরে ছিল বাইরে থেকে হস্টেলে ফেরার তাড়া। সামান্য দেরি হলেও অপদস্থ হওয়ার ভয় তাড়া করে ফিরত। তা ছাড়া রেহানার মতে, ছেলেদের হস্টেলের সঙ্গে মেয়েদের হস্টেলের একটা মূলগত ফারাক রয়েইছে। মেয়েদের অতিরিক্ত মাত্রায় ‘ভালনারেব্ল’ হিসেবেই সমাজ দেখে। ফলে সমাজ-শাসনের একটা ভয় তো রয়েই যায়। হস্টেলে পুরুষকর্মীদের তরফ থেকে ভয়ের কিছু না থাকলেও মেয়েরা খুব বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। টিউশন থেকে ফিরতে দেরি হলেও কথা শুনতে হত গেট কিপারের কাছ থেকে। পরবর্তী সময়ে কর্মরতা অবস্থায় রেহানা মেসে থেকেছেন। সেখানে স্বাধীনতা অনেক বেশি। কিন্তু বহিরাগতদের থেকে ভয়ের কিছু ব্যাপার কাজ করত। রুমমেটদের অনেকেই তাদের পুরুষবন্ধুদের মেসে নিয়ে আসত। মেয়েদের স্বভাবজাত ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ থেকে কখনও কখনও শঙ্কার আভাস পেয়েছেন তিনি।
রেহানার কথা থেকে উঠে আসা মেয়েদের ‘ভালনারেব্ল’ বা ‘দুর্বল লিঙ্গ’ হিসেবে দেখার যে সামাজিক নজর, তাকে অস্বীকার করার তেমন কোনও অবকাশ নেই। এই ‘ভালনারেবিলিটি’ থেকেই বলিউড, মায় হলিউডও রসদ পায় হরর ছবি নির্মাণের। সাহিত্যে একই বিষয় দেখা যায়। ১৯৭৩-এর ‘এগজ়রসিস্ট’ থেকে সাম্প্রতিকের ‘খওফ’— সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে এর উদাহরণ। আবার অন্য দিক থেকে দেখলে, মেয়েদের সমস্যার বিভিন্ন রকমফের রয়েছে, যা পুরুষদের থেকে আলাদা।
হস্টেলের সব ভয় কিন্তু অতিপ্রাকৃত নয়। ছবি: সংগৃহীত।
অহনা বিশ্বাস অধ্যাপনা করেন। সমান্তরালে লেখালিখি। মেয়েদের হস্টেল জীবন নিয়ে বইও লিখেছেন। ‘ভয়’ প্রসঙ্গে কথা তুলতেই অহনা জানালেন, তাঁর গ্রন্থে এই ভয়ের বিষয়টি অনুপস্থিত। কিন্তু সেটা তো রয়েছেই। অহনা জানালেন, অবশ্যই সেই সত্যিটাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিএড পাঠরতা মেয়েদের কলকাতার পুরনো হস্টেলে ভূতের গল্প আজ পডকাস্ট আর ভ্লগের দৌলতে প্রায় সকলেই জানেন। কিন্তু অহনার হস্টেল জীবন কেটেছে শান্তিনিকেতনে, বিশ্বভারতীর হস্টেলে। সেখানে সব থেকে বেশি ভয় ছিল চুরির। তার পরেই যে ভয়ের কথা অহনা জানালেন, সেটি কিছুটা হলেও ‘বিশেষ’। আজ থেকে দশক তিনেক আগেও বিশ্বভারতীর ওই বিশেষ হস্টেলটিতে মেয়েরা বাথরুমে যেতে ভয় পেত। ভূতের ভয় নয়। ‘খারাপ লোক’-এর ভয়। বাইরের কিছু লোক মেয়েদের হস্টেলের বাথরুমে উঁকি দিত, ঢিল ছুড়ত। এক বার কেউ একটা জীবন্ত ব্যাঙও ছুড়ে দেয়। তা নিয়ে সে সময় স্থানীয় স্তরে হইচইও হয়। সব মিলিয়ে সাত বছরের হস্টেল জীবন অহনার। বিশেষ ভাবে জানালেন, সেই সময়ে বিশ্বভারতীর হস্টেলে র্যাগিং ছিল না। তা নিয়ে প্যানিক তিনি দেখেননি। তবে হস্টেলের জবরদস্ত ওয়ার্ডেনকে সকলে ভয় পেত, সে কথা জানালেন।
সাংবাদিক ও চিত্রনাট্য লেখক শাঁওলি দেবনাথের হস্টেল জীবনও শান্তিনিকেতনে। তবে, বিশ্বভারতীর হস্টেলে নয়, তিনি থাকতেন প্রাইভেট হস্টেলে। প্রাথমিক ভাবে যে ভয়টির কথা শাঁওলি জানালেন, তা অচেনা জায়গায় থাকার ভয়। হস্টেলে এসে প্রথম যে ঘরটিতে ওঠেন, সেটি ছিল দু’জনের জন্য নির্দিষ্ট। এক জন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। আর একটা ভয় ছিল অন্ধকারের। শাঁওলি যে সময়ে হস্টেলে কাটিয়েছেন, সেই সময়ে লোডশেডিং ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। অন্ধকারে রাতে খাওয়ার ঘর বা রান্নাঘরে যেতে ভয় পেতেন। পরে একা একটি ঘরে থাকতে শুরু করেন। এই একাকী যাপনের সময়ে রাতে ঘরের আলো নেভাতেন না।
হস্টেলে এক বার একটা সমস্যা দেখা দেয়। আবাসিকদের মধ্যে এক জনের হাবভাব একটু রহস্যময় ছিল। সেই মেয়েটিকে ঘিরে একটা গুজব রটে যে, তিনি নাকি কালো জাদু জানেন। ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটি থাকতেন শাঁওলির পাশের ঘরেই। অন্যেরা মেয়েটিকে ভয় পেতেন, এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, শাঁওলির অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ভয় থাকলেও সেই মেয়েটির ব্যাপারে কোনও ভয়ের উদ্রেক হয়নি। তবে, সেই বয়সে শাঁওলি একটু নির্জনতাই পছন্দ করতেন। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ এবং হস্টেলে একা থাকার অভ্যাস তাঁকে সেই কাঙ্ক্ষিত নির্জনতাটুকু দিয়েছিল। ফলে ছোটখাটো ভয়ের বিষয়কে এড়িয়ে নিজের মতো করে দু’বছরের স্নাতকোত্তর পর্ব তিনি কাটাতে পেরেছিলেন।
এই যে ভয়ের কাহিনি, এর মনোবিদ্যা-সম্মত চরিত্রটি বা চরিত্রগুলি কী? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপের কাছে। মোহিত জানালেন, মেয়েদের হস্টেলের ক্ষেত্রে ভয় দু’রকম উৎসের। এক, অতিপ্রাকৃত বা ভূত-প্রেত সংক্রান্ত ভয়। আর দুই, মানুষকে ভয়, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভয়। এর মধ্যে প্রথমটির কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। মানুষ স্বভাবগত ভাবেই ভয় পেতে ভালবাসে, মত মোহিতের। যে কারণে মানুষ ভয় পাবে জেনেও হরর ছবি দেখে, ভৌতিক সাহিত্য পড়ে। মোহিত তাঁর পরিচিত একটি মেয়ের কথা জানালেন, যিনি আলিপুরদুয়ার থেকে এসে কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়তেন। তিনি ভৌতিক সাহিত্যের খুব ভক্ত। কিন্তু হস্টেলে অনেক সময়েই ছুটিছাটায় অন্যেরা বাড়ি চলে গেলেও কোনও কারণে তাঁর যাওয়া না হলে একা থাকতে হত। এবং সেই সময়ে তিনি বেজায় ভয় পেতেন। সুতরাং ভৌতিক সাহিত্যই হোক বা আজন্মলালিত বিশ্বাসজাত ভীতি, অতিপ্রাকৃত থেকে ভয়ের একটি বিশেষ চরিত্র আছেই।
দ্বিতীয় ভয়টি মোহিতের মতে, মানুষকে নিয়ে। প্রথমটির মতো এটি বাস্তব ভিত্তি-রহিত নয়। হস্টেলের ‘কেয়ার গিভার’ হিসাবে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সকলে নারী না-ও হতে পারেন। পুরষদের থেকে একটা নিরাপত্তাজনিত ভয় অনেকের মনেই কাজ করে। তার উপর হস্টেলের পরিবেশ, তার বাইরের মহল্লা নিয়েও কিছু ভয় ক্রিয়াশীল থেকেই যায়।
মোহিত জানালেন, এই দু’রকম বা অনেক রকম ভয় অনেক সময়েই মিলেমিশে যায়। অপরিচয়ের ভয়, নতুন পরিবেশের ভয়, একাকিত্বের ভয়, নিরাপত্তাহীনতার ভয় এবং অতিপ্রাকৃত সংক্রান্ত ভয় একত্র হয়ে এমন এক ভয়ের জন্ম দেয়, যার সঙ্গে হয়তো মেয়েটির প্রাক্-হস্টেল পর্বে পরিচয়ই ছিল না। এই ভয়গুলি থেকে বেরিয়ে আসা যে খুব কঠিন, তা কিন্তু মনে করছেন না মোহিত। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট ভয়ের ব্যাপারে যদি অনেকে মিলে সজাগ থাকেন, তা হলে তাকে প্রতিহত করা সম্ভব। পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ থাকলেই সেটা কয়ার যায়। এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের যোগফলকেই মোহিত ‘মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ বলে চিহ্নিত করছেন। আর অতিপ্রাকৃত বা প্রেতাত্মা সংক্রান্ত ভয়ের সঙ্গে যুঝতে গেলে দরকার যুক্তির। মনে রাখা দরকার, আত্মার অস্তিত্বই যেখানে প্রমাণিত নয়, সেখানে প্রেতাত্মা বিষয়টি যে অলীক, সে ধারণা রাখা প্রয়োজন।
মোহিত যে ভাবে বিবিধ ভয়কে একত্র করে একটি বিশেষ ভয়ে পরিণতি পাওয়ার কথা বলেছেন, সেটি প্রণিধানযোগ্য। ‘খওফ’ দেখতে বসলে বোঝা যায়, তার চিত্রনাট্য এই বিবিধ প্রকার ভয়ের সমাহারকেই তুলে ধরেছিল। বিবিধ প্রকার ভয়ই একাকার হয়ে সিরিজ়ের ‘হরর’কে তৈরি করছে, তা বোঝা যায় সিরিজ়টি দেখতে বসলে। এবং তার সমাধানও ছিল পঞ্চেন্দ্রিয়ের একীকরণ ও মেয়েদের সম্মিলিত শক্তির উত্থান। ভারতীয় ছবিতে ‘নারী নজর’ (ফিমেল গেজ়) আজও তেমন ভাবে হাজির নয়। ‘খওফ’-এর চিত্রনাট্যকার স্মিতা সিংহ সেই ‘নজর’টিকে তুলে আনতে বহুলাংশেই সফল। অন্তত এ দেশের মেয়েদের হস্টেলবাসের ইতিকথা তো সেই ইঙ্গিতই দেয়।