প্রতীকী চিত্র। চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
একজন বাঙালি যে এক বিষাদগ্রস্ত তিথিকে উৎসবে পরিণত করতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় একটা ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-ই বাঙালির বিষাদ তর্পণের দিন মহালয়াকে দুর্গাপূজার প্রারম্ভিকে পরিণত করেছে। বাস্তবে পিতৃপক্ষের সঙ্গে দেবীপক্ষের কোনও আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। পিতৃপক্ষের উপাদান শ্রাদ্ধ-তর্পণ, তিল-তুলসী-গঙ্গা, আর দেবীপক্ষের উপাদান ঢাক-ঢোল-চাঁদমালা, নতুন জামা। কিন্তু এই দুই পক্ষের একটা অলৌকিক সন্ধিপর্ব তৈরির কাজটি একেবারেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের।
ছোটবেলায় যখন পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য জীবন কাটিয়েছি, তখন ঘরের পাশেই নদী বয়ে যেত। পিতাঠাকুরকে দেখতাম— তিনি প্রতি দিনই নদীর কোমরজলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করতেন। সেখানে মহালয়ার দিনটা আমার কাছে পৃথক কিছু ছিল না। তবে বিশেষ এইটুকু দেখতাম যে, এই দিনটাতে জ্ঞাতিগুষ্টির আরও কয়েক জন নদীতে নেমে তর্পণ করতেন। কিন্তু এই পার্থক্যের কারণটা আমার ছোটবেলায় কিছু বুঝিনি, এমনকি ‘মহালয়া’ নামটাও যে আমার কাছে খুব পরিচিত ছিল, তা-ও নয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে যেই কলকাতায় এলাম, তখন আমার পিতার মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ দেখলাম— কেন না, তিনি গঙ্গায় তর্পণ করতে পারছেন। ব্যাপারটা আরও জমে উঠল, যখন আমার খুড়তুতো দাদা আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের বাড়ির বড় রেডিয়োর একটা অ্যান্টেনা ছাদে লাগাতে গেলেন। তিনি বললেন, ‘‘কাল মহালয়া। সকাল ৪টের সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’।’’
অথচ উপলক্ষটা একেবারেই অন্য ছিল— আমাদের কালীঘাটের বাড়িটা যেহেতু প্রায় গঙ্গার তীরেই ছিল, ফলত পিতৃ-মাতৃহীন অনেকেই আমাদের বাড়িতে মহালয়ার আগের দিনই চলে আসতেন— মহালয়ার তর্পণ করবেন বলে। কিন্তু তর্পণের এই স্মার্ত বাধ্যবাধকতার মধ্যে হঠাৎই শরৎ-শিউলির একটা উন্মাদনা চলে এল সকাল চারটের সময়। মুহূর্তের মধ্যে পিতৃপক্ষের শেষ দিন দুর্গাপুজোর প্রারম্ভিকে পরিণত হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সৌজন্যে। আমি আগেও মহালয়ার দিন দেখেছি, তখনও মহালয়ার দিন দেখলাম। রাত্রি ১০টার সময়ে রেডিয়ো কাঁটাটিকে একেবারে যথায়থ তরঙ্গে স্থাপন করে, তাকে বার বার পরীক্ষা করে রাখা হল, যাতে ভোর ৪টের সময় একটা সেকেন্ডে একটা শব্দও যেন বিফলে না যায়। টেবিল-ঘড়িতে ৩টে ৪০-এ অ্যালার্ম, যাতে সকলে চোখ-মুখ ধুয়ে রেডিয়োর ধারে-কাছে বসে পড়তে পারে। বাচ্চারা যেমন বড়দের ভয় দেখলে ভয় পায়, তেমনই বড়দের আনন্দ দেখলে তারাও আনন্দের উন্মাদনায় শামিল হয়। আমরাও ঠিক তেমনই ছিলাম।
মহালয়া দু-তিন বছর এই ভাবে চলার পর আমি এক বার আমার বাড়িউলি বৃদ্ধাকে দেখলাম— তিনি সকালে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শোনার পরেই ‘দুর্গে দুর্গতিনাশিনী’ বলে সমস্ত ঘরগুলিতে গঙ্গাজল ছিটোলেন। আমি সেদিন বুঝলাম— ‘তিল-তুলসী-গঙ্গা’ শরৎ-শিউলি-কাশে পরিণত হল।
ছোটবেলায় গ্রাম্য কাকা-জ্যাঠাদের বাড়িতে কেউ গতায়ু হলে সেই শোকতাপ আমাদের স্পর্শ করত। অবশেষে শ্রাদ্ধের দিনে সেই বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে দু’টি শব্দ এমন ভাবেই পুনরাবৃত হত, যাতে কোনও শব্দবোধ ছাড়াই কেমন যেন ভারাক্রান্ত হত আমার হৃদয়। একটা ছিল— ব্রাহ্মণায় অহং দদানি— আমি এটা ব্রাহ্মণকে দিচ্ছি। আর দ্বিতীয় বাক্যটি হল, শেষের দিনে সেজন বিনে— ওঁ গয়া-গঙ্গা-গদাধরো হরিঃ। প্রিয়জনবিহীন মানুষটি প্রিয়জনের প্রতিরূপী ব্রাহ্মণকে দান করছেন— এতে ব্রাহ্মণত্ব খণ্ডিত হয়, না কি ব্রাহ্মণের লাভের পথ প্রশস্ত হয়, সে তর্ক থাক। কিন্তু গয়া-গঙ্গা-গদাধরো হরিঃ— এই বাক্যে প্রয়াতজন জীবিতজনের কাছে পিণ্ড লাভ করছেন অর্থাৎ খাবার পাচ্ছেন— এই ভাবনাটা অদ্ভুত এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করে দেয় মৃত এবং জীবিতের মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দেশে শ্রাদ্ধ-পিণ্ড অন্ত্যেষ্টির পরে একটা শ্রাদ্ধকৃত্যেই শেষ হয়ে যায় না। পিতৃ-মাতৃ-সুহৃদবর্গকে মনে রাখার জন্য বার বার বাৎসরান্তিক তিথি ফিরে আসে— সপিণ্ডকরণ থেকে তিথিপালন, কোনওটাই বাদ যেত না সেকালে।
আমি বার বার বলার চেষ্টা করেছি যে, সেকালে যে সব স্মার্ত বিধান চালু হয়েছিল, তার বেশির ভাগই তৎকালীন সমাজের ইচ্ছা এবং মানসিকতা থেকেই তৈরি হয়েছিল। শ্রাদ্ধ মানে শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কিন্তু শ্রদ্ধা প্রকট করে তোলার জন্য যে ঘটা এবং আড়ম্বর শ্রাদ্ধের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, সেটা বড়লোক যজমানের আড়ম্বরী ভাবনা এবং ব্রাহ্মণের দান-লাভের ইচ্ছায় তৈরি হয়েছিল। আর সাধারণ ক্ষেত্রে পিতার জমি-জিরেত এবং সম্পত্তির উত্তারাধিকার লাভও কিন্তু অনেক সময়েই ঋদ্ধ শ্রাদ্ধকার্যের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই শ্রাদ্ধকার্যের পরম্পরা হল সপিণ্ডকরণ এবং তার পর থেকে পিতামাতার মৃত্যুতিথি পালন, যদিও এই তিথিতেও একটা শ্রাদ্ধকর্ম করাটাই বিধেয়। কিন্তু উত্তরাধিকারীর সময়, অর্থ এবং স্মৃতির বিড়ম্বনায় শ্রাদ্ধকর্মটা যেহেতু করে ওঠা হয় না, তাই তর্পণ করার পথটা প্রশস্ত হয়ে উঠেছে খুব তাড়াতাড়ি।
তর্পণ মানে তৃপ্ত করা, খুশি করা। এখনকার দিনে প্রচলিত হয়েছে ‘ফাদার্স ডে’ আর ‘মাদার্স ডে’। যাঁরা বেঁচে থাকতেই বাবা-মাকে ভুলে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য এই বিশ্বব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু কোনওকালে জীবিত পিতা-মাতাকে যাঁরা ভুলতেন না, এমনকি মরার পরেও ভুলতেন না বলে প্রতি দিন নদী-পুষ্করিণীর জলে আধডোবা শরীরে তাঁদের আহ্বান করতে জলগ্রহণ করার জন্য, আমাদের বিশ্বাসে তাঁরা নেমে আসেন ছেলের হাতের জল পাওয়ার জন্য। এই যে তর্পণ, যা প্রতি দিন বিধেয়, সেটা যদি প্রতি দিন করা সম্ভব না হয়, তা হলে সেই বাস্তব বুঝেই বছরে পুরো পনেরোটি দিন ধার্য করেছেন আমাদের শাস্ত্রকারেরা। যার নাম পিতৃপক্ষ এবং সেই পিতৃপক্ষের শেষ দিন বা চরমতম দিন হল মহালয়া তিথি। অর্থাৎ যাঁরা এই পনেরো দিনের চোদ্দো দিনও তর্পণ করতে পারলেন না, তাঁদের জন্য শ্রেষ্ঠ তিথি হল মহালয়া।
আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও কলকাতা হাইকোর্টে সমস্ত ইচ্ছুক অফিস কর্মচারীদের জন্য নোটিস পড়ত— যাঁরা ‘টারপ্যানিস্ট’ আছেন, তাঁরা এই চোদ্দো দিনের কোনও একটা সময় এক ঘণ্টা ছুটি পাবেন পাশের গঙ্গায় তর্পণ সেরে আসার জন্য অথবা এক ঘণ্টা দেরিতে অফিসে আসতে পারেন। আর মহালয়ার দিন ছুটি— সেটা পুজোর ‘প্রিলিউড’ হিসেবে নয়, পিতৃতর্পণ করবেন বলেই ছুটি। মহালয়ার গুরুত্ব নাকি এটাই যে, ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশে আমাদের প্রয়াতজনেরা— প্রয়াত পিতা-মাতারা সূক্ষ্ম দেহে নেমে আসেন মর্তভূমির পরিমণ্ডলে। প্রয়াত পিতা-মাতাদের এই বিশাল (মহান) সমাবেশ (আলয়, আবাস) এই দিন অন্তরীক্ষে তৈরি হয় বলেই এই দিনটার নাম মহালয়া। ‘তিথি’ শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ বলে তিথির বিশেষণে ‘মহালয়’ স্ত্রীলিঙ্গে মহালয়া বলে পরিচিত। মহালয়াতে শ্রাদ্ধ করাটা এতই পুণ্যের যে, এই শ্রাদ্ধে নাকি গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করার ফল মেলে। কিন্তু মহালয়ার সার্বিক বিশিষ্টতা হল— তর্পণ— পিতৃপক্ষের অন্তিম তর্পণ।
আমাদের দেশটাই এমন একটা আন্তরিক দেশ, যেখানে পাশ্চাত্য ‘এসক্যাটোলজি’র ধ্যানধারণা মেলে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রয়াত হলেও মানসিক ভাবনায় তাঁদের সঙ্গে আমাদের বিচিত্র সম্পর্কসেতু তৈরি হয়েছে। প্রয়াত হওয়ার পরেও তাঁদের অন্নপান যেন ঠিকমতো চলে, তার জন্য জীবিত জনের অনেক দুশ্চিন্তা থাকে। সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য দেবলোকের তলায় তলায় একটা পিতৃলোকের ব্যবস্থা করেছেন শাস্ত্রকারেরা এবং সেই পিতারাও বেশ ‘পাওয়ারফুল’। এই পিতৃলোকেই প্রয়াত মাতা-মাতামহীরাও থাকেন। একটি পুরুষ বা একজন স্ত্রীলোককে কখনও একটা গোটা মানুষ ভাবেননি আমাদের শাস্ত্রকারেরা। বৃহদারণ্যক উপনিষদের মতো প্রাচীন উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্যের মতো বহুমান্য ঋষি বলেছেন, একটা পুরুষের শরীর হল অর্ধাংশশূন্য শস্যবীজের– দ্বিদল দালের অর্ধেক দানার মতো। যে অর্ধাংশ ফাঁকা, সেখানে স্ত্রীশরীর এলে তবেই না একটা গোটা মানুষ হয়— তস্মাদিদম্ অর্ধবৃগলমিব স্ব ইতি স্মাহ যাজ্ঞবল্ক্যঃ, তস্মাদয়মাকাশঃ স্ত্রিয়া পূর্য্যতে এব— এই অর্ধেক আকাশ পূরণ করে স্ত্রীলোক— দুয়ে মিলে তবে একটা মানুষ।
এই ভাবনা থেকে পিতা এবং মাতাকে সংস্কৃতে একসঙ্গে দ্বিবচনে ‘পিতরৌ’ বলা হয়, ফলত প্রয়াত মানুষের আবাসিকটাকে খানিক পিতৃতান্ত্রিকতাতেই হয়তো ‘পিতৃলোক’ বলা হয়েছে এবং এই পিতৃলোকের কিন্তু একটা অলৌকিক পরিকল্পনা আছে। ধারণা করা হয়— জীবিত জনের তিন প্রয়াত পুরুষের তিনটি ‘জেনারেশন’ এই পিতৃলোকে থাকেন, তাঁদের আগের সব জেনারেশনকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন যমরাজ। কেন না পিতৃলোকের দেখভালের ব্যবস্থা যমরাজের হাতে। পিতৃলোকের এই তিন পুরুষের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও চমৎকার। পিতামাতার উদ্দেশে আমরা যে পিণ্ডদান করি, তাতেই তাঁদের খাওয়া চলে। খেয়াল করে দেখুন, প্রয়াত পিতা-মাতাদের উদ্দেশে আমরা যে শ্রাদ্ধ করি, তার এক বছর হল সপিণ্ডকরণ। আমাদের এক বছর, পিতৃলোকের এক দিন। অর্থাৎ বার্ষিক সপিণ্ডকরণের দিন তাঁদের অন্ন-পান দিলাম আমরা। এই ভাবে প্রতিটি বার্ষিক শ্রাদ্ধে এই এক দিনের অন্ন-পান চালিয়ে গেলে পিতা-মাতারা পরম সুখে আশীর্বাদ করতে থাকেন। তার মধ্যে বাড়তি খাবারও জুটে যায়— অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহের নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ।
লক্ষণীয়, এই সমস্ত প্রকার শ্রাদ্ধে পিতা-মাতা সহ পূর্ববর্তী তিন পুরুষকেই শ্রাদ্ধ পিণ্ড দান করতে হয়, দিতে হয় জল। তা হলে এই যুক্তিটাই সার্থক হল যে, পূর্ববর্তী তিন পুরুষই পিতৃলোকে থাকেন, যাঁদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন সুশাসক যমরাজ। যদিও এই খাওয়াদাওয়ার ‘স্পনসরশিপ’ প্রয়াত বংশপুরুষদের উত্তরাধিকারী জীবিত বংশধরদের হাতেই। ফলত এই যে পিতৃলোকের শ্রাদ্ধতর্পণ, সেটার অন্তিম স্থান হল মহালয়া— যার সঙ্গে চোদ্দোটি পিতৃপক্ষের দিন জুড়ে আছে। এই সময়ে প্রয়াত পিতৃগণ এবং মাতৃগণ মর্তভূমির সবচেয়ে কাছে আসেন, হয়তো বা বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থায় বংশধরদের ঘরের মধ্যেই প্রায় চলে আসেন— সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নির্দেশেই নাকি স্বসৃষ্ট বংশধরদের এই ভাবে করুণা করেন তাঁরা।
মহালয়া তিথির এই তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্য তার আগের চোদ্দো দিনের মধ্যে অনুসৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটা কৌতুকপ্রদ কাহিনি না বললেই নয়। কথিত আছে, মহাভারত মহাকাব্যের বিখ্যাত চরিত্র কর্ণ, যিনি দানের সময় কাউকে ফেরাতেন না বলে ‘দানবীর কর্ণ’ নামে খ্যাত হয়েছেন, সেই কর্ণ যুদ্ধকালে অর্জুনের হাতে মৃত্যুবরণ করার পর বীরের সদ্গতি লাভ করে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে তাঁকে স্বাভিনন্দনে বরণ করে নিলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র, মতান্তরে যম। অভিনন্দন-আবাহনের পর্ব শেষ হলে কর্ণকে খেতে দেওয়া হল থালা সাজিয়ে। কিন্তু সে থালায় খাদ্য হল সোনার তৈরি নানা অলঙ্কার, হিরে-মোতি, চুনি-পান্না। কর্ণ এই অদ্ভুত বিপ্রতিপত্তি দেখে দেবরাজের কাছে জিজ্ঞাসু হতেই তিনি বললেন, ‘‘দ্যাখো বাছা! তুমি এতদিন যত দান দিয়েছ ব্রাহ্মণদের, সেখানে অন্ন-পান, খাবার জিনিস কাউকে কিছু দাওনি। সেই কারণেই খাবার হিসেবে তোমারে সোনাদানা মণিরত্ন দিয়েছি। বিশেষত, পিতৃমাতৃকুলের কারও উদ্দেশে তুমি একটা পিণ্ড পর্যন্ত দাওনি। ফলে তোমার খাবার থালায় শুধু দানের জিনিস, কোনও অন্ন-পান নেই।’’
কর্ণ বললেন, ‘‘দেখুন, আমি তো সারা জীবন জানতামই না আমার পিতা-মাতা কে, আমার পিতৃপুরুষের তালিকাতেই বা কারা আছেন? সেখানে আমি পিণ্ড দেব কার উদ্দেশে?’’ ইন্দ্র বললেন, ‘‘বেশ তো, এখন তো তুমি সব জানো। আর তুমি এত বড় দানবীর বলেই তোমাকে বলছি— তোমাকে আমরা পনেরো দিনের জন্য আবার মর্তে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। এই প্রতিপদ থেকে মহালয়া অমাবস্যা পর্যন্ত সময় ধরে তুমি পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ড দাও। তার পর মহালয়ার পরেই ফিরে এসো। তখন এখানেও তোমার সুব্যবস্থা হবে।’’
কর্ণ ফিরলেন ধরণীতে। পিতৃমাতৃগণের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ-তর্পণ করলেন। তার পর যখন ফিরলেন স্বর্গলোকে, তখন ইন্দ্র বললেন, ‘‘তোমার এই পিতৃমাতৃকর্মের পনেরো দিন এখন থেকে ‘পিতৃপক্ষ’ বলে জগতে পরিচিত হবে এবং এখন তোমার আবাস স্থান হোক এই পিতৃলোক।’’
কাহিনিটি জনশ্রুত-পরম্পরায় বাহিত হলেও বেশ উদ্ভাবিত বটে। অতএব এই পিতৃপক্ষের শেষ দিন মহালয়া দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত কোনও মহোৎসব নয়, বরং এটা পিতৃপুরুষের মহোৎসব— অন্য কোনও সময়ে তর্পণ না করলেও মহালয়ার তর্পণে সর্বসিদ্ধি। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক এইটুকুই যে, এই দিনেই দুর্গার-মূর্তি কারিগরেরা অনেকেই দুর্গামূর্তির চক্ষুদান করেন— হয়তো বা এই জন্যেই যে মা জননী চোখ খুললেই দেখবেন— তাঁর সন্তানেরা পিতা-মাতা পিতৃপুরুষকে ভোলেনি। মহালয়ার তর্পণ সেরেই তাঁরা বিশ্বাত্মিকা জগজ্জননীর পূজা-আরাধনায় মন দেবে— পাঁচ দিনের সাড়ম্বর মাতৃতন্ত্র পনেরো দিনের পিতৃতান্ত্রিকতাকে পরের বছরের জন্য জমা করে দেবে।