Filmmaker Anuparna Roy

‘এ মুহূর্তে আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমী কে?’ ভেনিস থেকে পুরস্কার নিয়ে ফিরে প্রশ্ন চলচ্চিত্রকার অনুপর্ণার

ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে ওরিজ়োন্তি বিভাগে প্রথম বার সেরা পরিচালকের পুরস্কার ভারতীয়ের হাতে। সে মুহূর্তের রেশ এখনও কাটেনি পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপর্ণা রায়ের। তার মধ্যেই ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ়’-এর স্রষ্টা কথা বললেন তাঁর জীবন, পরিবেশ, পরিবার, পুজোর পরিকল্পনা নিয়ে।

Advertisement

তিস্তা রায় বর্মণ

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫
Share:

পরিচালক অনুপর্ণা রায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম বার ওরিজ়োন্তি বিভাগে সেরা পরিচালকের পুরস্কার উঠল কোনও ভারতীয়ের হাতে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে অস্পষ্ট, কম্পিত গলায় কৃতজ্ঞতা স্বীকার এবং শোষিতদের পাশে দাঁড়ানোর শপথগ্রহণ। অবিশ্বাস্য সেই মুহূর্তের রেশ এখনও কাটেনি। এখনও পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপর্ণা রায়ের গলা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। রাতারাতি জীবনটা যেন পাল্টে গিয়েছে ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ়’-এর স্রষ্টার।

Advertisement

প্রশ্ন: হঠাৎ জীবনটা যেন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে! সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে না?

অনুপর্ণা: যেটা সবচেয়ে বেশি অন্য রকম মনে হচ্ছে, তা হল আমার প্রতি লোকের ব্যবহার। এত সম্মান কখনও পাইনি। ভালবাসাও পাচ্ছি অনেক। সমাজ যে আমাকে এত অভিজ্ঞতার সুযোগ দিচ্ছে, তার জন্য আমি ভাগ্যবান বলে মনে করছি নিজেকে। বাকিটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। ঘোরেই আছি মনে হচ্ছে। তবে এ সবের মাঝে আক্রমণও আসছে প্রচুর। পুরস্কার পাওয়ার পর মঞ্চে উঠে আমি মানবতার খাতিরে কয়েকটা কথা বলেছিলাম, সেটিতে রাজনৈতিক রং লাগানোর চেষ্টা চলছে চার দিক থেকে। কিন্তু আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নই, প্রতিনিধি নই। আমি কেবল আমার জন্মভূমির প্রতিনিধি হয়ে সেখানে গিয়েছি।

Advertisement

প্রশ্ন: প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন, সে সব নিয়েই আক্রমণ শুরু হয়েছে?

অনুপর্ণা: হ্যাঁ! অনেকের ধারণা, প্যালেস্তাইনে ঘটে চলা নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই আমাদের দেশের শাসকদলের বিরোধিতা করা। কিন্তু আমি তো কেবল হাজার হাজার শিশু এবং নির্দোষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করার বিরোধিতা করেছি। নিজের দেশের কোনও রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। শাসকদলের সদস্যেরাও আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমার আশপাশে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁদের মানসিকতায় এই হিংস্রতা প্রকাশ পায়। আমি কেবল সেই মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমী কেউ নেই। কারণ, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে কেবল একটি ভারতীয় ছবির জন্য দেশের জাতীয় পতাকা উড়েছে। আর সেই কৃতিত্বটুকু তো আমার পাওনা, তাই না?

প্রশ্ন: চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার ঘোষণার মুহূর্তটা কি ছিল শুধুই স্বপ্নের মতো?

অন্নপুর্ণা: সত্যিই স্বপ্নের মতো। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অসম্ভব ভয় পাচ্ছিলাম। উঠে দাঁড়ানোর পর মনে হচ্ছিল, হয়তো আমি পড়ে যাব লুটিয়ে। মাইক হাতে পেয়ে মনে হচ্ছিল, সবার নাম মনে করে করে বলতে পারব তো? কারও নাম বাদ যাবে না তো? কত কিছু যে চলছিল!

প্রশ্ন: মা, বাবা এবং বোন কী বলছেন? আর পুরুলিয়ার আত্মীয়স্বজন?

অনুপর্ণা: খুব খুশি। খুবই। মা তো উৎফুল্ল। পুরুলিয়া থেকে কত কত মানুষ শুভেচ্ছা, অভিনন্দন জানাচ্ছেন! আসলে অনেক বছর আগে ছবি বানানোর জন্যই পুরুলিয়া ছেড়ে এসেছিলাম। কিন্তু প্রথম ছবি সেই পুরুলিয়াতে গিয়েই বানাই।

প্রশ্ন: বাড়ি ছেড়ে দূর শহরে থাকা— পরিবারের আপত্তি ছিল না?

অনুপর্ণা: স্নাতক পাশ করার পর পরই ছবি বানানোর জন্য দিল্লি চলে যাই। সে সময়ে মা-বাবার থেকে দূরে থাকাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তার কারণ, আমি যে কাজটা করতে চলেছি, তার জন্য পরিবারের তরফে নানাবিধ বাধানিষেধ আসতে পারত। আর সে সময়ে কোনও রকম শিকলে বাঁধা পড়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। ২০১৫ সাল থেকে আমি বাড়িছাড়া। বাবা খানিক কঠোর হলেও মা কিন্তু বরাবর আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এখন অবশ্য সবাই খুব খুশি।

অনুপর্ণা রায়ের ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: ছবি বানানোর শখ কবে মাথাচাড়া দিল?

অনুপর্ণা: কলকাতার এক প্রান্তিক জেলার মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখাই দুঃসাহসিক। ন’পাড়ায় আমার স্কুলজীবন কাটে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে বর্ধমান জেলায় চলে যাই। খুবই সাধারণ ছাত্রী ছিলাম। সাহিত্য ভাল লাগত বলে পড়তাম, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নয়। তাই বোঝাই যাচ্ছে, বেশ সাধারণ নম্বরই পেতাম (হেসে)। স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করতে করতেই সিনেমা বানানোর ভূত চাপল মাথায়। কিন্তু সিনেমা কে বানায়, কী ভাবে বানায়, সেটুকুও জানতাম না। কী বানাব, কবে বানাব, সে সব না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু জানতাম, সিনেমাই তো বানাব আমি, এটাই আমার ভবিতব্য।

প্রশ্ন: দিল্লি আর মুম্বইয়ে গিয়ে নতুন জীবন শুরু?

অনুপর্ণা: হ্যাঁ। প্রথমে দিল্লি যাই। কলসেন্টারে চাকরি পাই একটা। তাই টাকাপয়সার চিন্তা কমতে থাকে ধীরে ধীরে। নিজের ছোট্ট সংসার চালানোর পাশাপাশি লেখালিখির কাজ শুরু করে দিই। দিল্লি যাওয়ার পর একটি ছবির চিত্রনাট্য লিখি। সেটি শুট করি পুরুলিয়ার ন’পাড়াতে এসেই। নিজের মাতৃভাষাতেই। কলকাতার বাংলায় নয়। আর সে ছবি নিয়ে রাশিয়া, জার্মানি সব ঘুরতে পেরেছি। নানা জায়গায় ছবিটা দেখানো হয়। তার পর বুঝতে পারি, ছবি বানাতে হলে মুম্বইয়ে গিয়ে না থাকলে হবে না। আমরা যে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে এখানে থাকি, সেখানেই ‘সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ়’ শুট করি। তখনও চাকরি করি আমি। কিন্তু কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ফলে নিজেকে চালাতে পারছিলাম না আর। তখন সে-ই বাবাই কিন্তু আমাকে সাহায্য করেছেন। ছোটবেলার মতো হাতখরচ দেওয়া, মুম্বইয়ের বাড়িভাড়া দেওয়া, ইত্যাদি। দেখতে গেলে, দুশ্চিন্তা করারই মতো, কিন্তু বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে সাহসে ভর করে অচেনা শহরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছি। আজ আমার কোনও অচেনাকেই আর ভয় করে না তাই।

প্রশ্ন: ছবি বানানোর জন্য বাড়িছাড়া হতেই হল, তা হলে কলকাতা নয় কেন?

অনুপর্ণা: ওই যে বললাম, একেবারে অচেনা শহর থেকে শুরু করতে চেয়েছিলাম। ব্যক্তিগত জীবনেও সকলের থেকে দূরে গিয়ে নিজের মতো কাজ করতে চাইছিলাম সে সময়ে। কিন্তু চলচ্চিত্র সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি যখন ‘রান টু দ্য রিভার’ আমাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে সিনেমাটা এডিট করছিলেন, সে সময়ে আমি তিন মাস কলকাতায় ছিলাম। সে সময়ে ফিল্ম স্কুল যেমন ‘সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট’-এর মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাংলার ছবির জগৎটাকে চিনতে শিখি। পাশে পাই আরও কত কত ছেলেমেয়েকে, যাঁরাও ছবি বানানোর জন্য কষ্ট করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

প্রশ্ন: টলিউড ইন্ডাস্ট্রির কত তারকা আপনার জয়ধ্বনি তুলছেন!

অনুপর্ণা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন দেখে বড্ড ভাল লেগেছে। ওঁর কাজ বহু দিন ধরে পছন্দ আমার। তার পর রাইমা সেন আমাকে ইনস্টাগ্রামে অনুসরণ করেছেন। এতখানি ভালবাসা পাব ভাবিনি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, জয়া আহসান, বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এই সকল তারকার অনুরাগী আমি। কাজ দেখি। যাঁরা বাংলা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কুমন্তব্য করেন, তাঁদের বলতে চাই, এখানে সবাই সবার পাশে দাঁড়ান, একজোটে সবাই কিছু ভাল কাজ করার চেষ্টা করছেন, কোথায় দেখতে পাওয়া যায় এমন? আর আমার সবচেয়ে বড় পাওনা, এই জয়লাভকে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা সকলের জয়লাভ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

প্রশ্ন: তা হলে কি বাংলায় এসেও ছবি বানানোর পরিকল্পনা শুরু করা যায়?

অনুপর্ণা: এখন মনে হচ্ছে, যদি সুযোগ পাই, তা হলে কলকাতা শহরটাকে আগে চিনতে চাই। তার পর ছবিও বানাতে চাই। অবশ্য আমি পুরুলিয়ার ভাষাতেই ছবি বানাতে চাই। আমার বাংলায়। আমার মাতৃভাষায়।

প্রশ্ন: কিন্তু বাংলা থেকেই বিতর্ক শুরু হচ্ছে টুকটাক। কী ভাবে সামলাবেন?

অনুপর্ণা: কেমন বিতর্ক? আমি জানি না তো।

প্রশ্ন: পরিচালক, চিত্রনাট্যকার সোহিনী দাশগুপ্ত ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছেন, তাঁর ছবি ‘ছোটিমোটি বাতেঁ’র সঙ্গে আপনার ছবির কিছু মিল পেয়েছেন। যদিও আপনার সিনেমাটোগ্রাফার শাক্যদেব চৌধুরী জানিয়েছেন, এই গল্প আপনার একান্ত ব্যক্তিগত।

অনুপর্ণা: তা হলে উত্তর তিনি পেয়েই গিয়েছেন। এই সব বিষয়ে আমি কাউকেই কিছু উত্তর দিতে চাই না আলাদা করে। কারণ, আমার ছবি একেবারে আমার নিজস্ব গল্প, নিজস্ব চিত্রনাট্য থেকে তৈরি। এগুলি আমার পাশে ঘটে যায়, আমি আলাদা করে বসে ভাবি না। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এই মন্ত্রে চলি আমি।

প্রশ্ন: তা হলে কী ভাবে এই বিষয়টি আপনার চিত্রনাট্যে জায়গা পেল?

অনুপর্ণা: এই গল্পটা আসলে সত্যিই আমার একান্ত ব্যক্তিগত গল্প। আমার দিদার জীবনের ছোট্ট একটা দিক এখানে গল্প হয়ে দেখা দেয় আসলে।

প্রশ্ন: কী রকম গল্প?

অনুপর্ণা: আমার দিদা আর তাঁর সৎকন্যা প্রায় এক বয়সি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটা অসম্ভব সুন্দর বন্ধুত্ব, অন্য রকমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন দাদুরও মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। কোনও পুরুষ ছাড়াই তাঁরা সুন্দর নিজেদের জীবনে সুখী ছিলেন। এই গল্পটাই আমায় অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে অনুপর্ণা রায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: বিশেষ নজর কেড়েছে আপনার সাজ। হালকা শাড়ি আর হাতকাটা ব্লাউজ়!

অনুপর্ণা: হ্যাঁ, আসলে খুব ভারী শাড়ি পরার অভ্যাস নেই একেবারে। কিন্তু শাড়ি তো পরতেই হত। বাঙালি বলে কথা। তাই সুতি আর সিল্ক মেশানো এই শাড়িটি পরেছিলাম। এই শাড়ির সঙ্গে একটা গল্পও আছে। আমার এক বন্ধু আছেন মুস্কান মিত্তাল, অসমে থাকেন, পোশাকশিল্পী। তাঁকেই বলেছিলাম একটা শাড়ি বানিয়ে দিতে, যেটার উপরে পুরুলিয়ার দেওয়ালচিত্র আঁকা থাকবে। তো এ ভাবেই শাড়িটা বানানো হয়।

প্রশ্ন: আপনি কি বেশির ভাগ সময়ে শাড়িই পরেন?

অনুপর্ণা: কোনও অনুষ্ঠানে গেলে পরি। মুম্বইয়ে খুব একটা পরা হয় না। তবে দুর্গাপুজোর সময়ে শাড়ি পরাটা যেন বাধ্যতামূলক।

প্রশ্ন: অন্যান্য বারের চেয়ে একেবারে আলাদা এ বারের পুজো। কলকাতায় পা পড়বে কি?

অনুপর্ণা: গত ১০ বছর পুজো দেখিনি কলকাতায়। মুম্বইয়ে প্যান্ডেলে যাই বটে বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু এ বার ভাবছি, পুরুলিয়া আর কলকাতায় পুজো দেখব। সকলের সঙ্গে দেখাও হবে। কলকাতায় এই ছবিটা দেখানোরও ইচ্ছা আছে। অনেকেই বলছেন, তাঁরা ছবি দেখতে চান। ফলে এ বারের পুজো সত্যিই একটু আলাদা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement