সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
জীবনে মাতৃত্বের বিভিন্ন আঙ্গিকের সাক্ষী থেকেছি। বেণীর (দামিনী বেণী বসু) সঙ্গে আমার এক সন্তান। পৃথার (পৃথা চক্রবর্তী) সঙ্গে আমার দুই সন্তান। তারা দু’জনেই খুব ভাল মা। তবে মাতৃত্ব প্রসঙ্গে আমার উপলব্ধি, মা যেন মায়ের মতোই হন। মা যদি তাঁর সন্তানকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেন, তা হলে সেটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে!
আমার জীবনে দুই মা। এক জন যিনি (স্বপ্না মুখোপাধ্যায়) আমাকে জন্ম দিয়েছেন। আর প্রকৃতি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ তো আমরা প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করি। আমি একজন বাবা হিসেবে বলছি, সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমি নানা পরিস্থিতিতে বাবার দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মাকে দেখেছি। ব্যক্তিজীবনে আমি তিন সন্তানের বাবা। আবার বিভিন্ন সময়ে পর্দায় কখনও বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছি। আবার কখনও বাবার মতো কেউ হয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। সেই দায়িত্ব পালন করা কিংবা না করা, এবং ব্যক্তিজীবনে নিজের সন্তানদের প্রতি ভালবাসা— সব জায়গা থেকে দেখে বলছি, মা কিন্তু আলাদাই।
২০১৫ সালে আমার মা প্রয়াত হওয়ার পর থেকে বিশ্বাস করি, সব সময়ে তিনি আমার সঙ্গেই রয়েছেন। এখন আধুনিক সমাজে মাতৃত্বের রূপও বদলে যাচ্ছে। ‘সিঙ্গল মাদার’ থেকে শুরু করে ‘কো-পেরেন্টিং’— বিভিন্ন শব্দবন্ধের প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে মা যেন মা-ই। তাঁর কোনও বিকল্প হতে পারে না। সন্তানের প্রতি তাঁর স্নেহ এবং স্বার্থত্যাগকে শ্রদ্ধা করা উচিত।
প্রাক্তন স্ত্রী দামিনী বেণী বসুর সঙ্গে সুদীপ-কন্যা। ছবি: সংগৃহীত।
আমরা তিন ভাই। বাবা ছিলেন সেনায় কর্মরত চিকিৎসক। মাকে দেখতাম, একা হাতে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতেন। এখন বুঝতে পারি, ছোটবেলায় মাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছি। প্রচণ্ড দুষ্টুমি করতাম। মা সেগুলো হাসিমুখে মেনেও নিতেন। সংসারের হাল ধরেও মা কিন্তু তাঁর শখ-শৌখিনতা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।
‘পেরেন্টিং’ কিন্তু ভালবাসার ফল, সেটা অঙ্ক কষে সম্ভব নয়। শিক্ষকদেরও অভিভাবকের সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে একটা পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। কিন্তু সন্তান প্রতিপালন বিষয়টা ন্যাচারাল। মা তাঁর সন্তানকে স্তন্যপান করাবেন, এটা তো অঙ্ক কষে বা কম্পিউটারের সাহায্যে সম্ভব নয়! তাই প্রত্যেক সন্তানের সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কও ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে পারে। সেটা তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানেই ‘নাড়ির টান’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দুই সন্তানের সঙ্গে সুদীপ এবং পৃথা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রয়োজনে একজন বাবাও মানসিক দিক থেকে সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। মায়েদের ক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি তাঁদের বিভিন্ন অভিব্যক্তি এবং অনুভূতির সঙ্গে বাবার মিল পাওয়া যে কঠিন, সেটা আমিও জানি। কারণ ছোট থেকেই দেখেছি, বাবারা একটু চুপচাপ। অর্থ উপার্জন করে তাঁরা সংসারের চাকাটাকে ঘোরাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি জুগিয়ে চলেন। তাঁরা মায়ের মতো নমনীয় নন। কিন্তু আমার আশপাশে এমন বহু পরিচিত বাবাকে দেখেছি, যাঁরা কিন্তু তাঁদের সন্তানকে খুব সুন্দর ভাবে একা হাতে বড় করে তুলেছেন। সিনেমাতেও এই ধরনের গল্প বার বার ফিরে এসেছে। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে বিজয় সেতুপতি অভিনীত সাম্প্রতিক ‘মহারাজা’ ছবিটির কথা। একজন বাবা তাঁর সন্তানদের জন্য কী কী করতে পারেন, ছবিটা দেখলে স্পষ্ট হয়।
আমাদের দেশে সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমায় মায়েদের চেহারাও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ থেকে শুরু করে শ্রীদেবী অভিনীত ‘মম’— অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে ছোট পর্দায় আমার অভিনীত দুটো চরিত্রের সমান্তরাল তুলনা করতে চাই। এই দুটো ধারাবাহিকের মাধ্যমে আমিও দুই ভিন্ন মাকে চাক্ষুষ করেছি।
‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) ইন্দ্রাণী হালদার, সুদীপ মুখোপাধ্যায় এবং উষসী চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
সাংসারিক জীবনে পা রেখে কখনও কখনও স্বামীরা তাঁদের স্ত্রীদের ‘পকেটে পুরে’ ফেলেন। কারণ বাইরের জগতে ঘুরতে ঘুরতে ধরেই নেওয়া হয়, এটা তো আমার স্ত্রী করবেই। ফলে কোথাও গিয়ে অন্দরমহলে ফাটল ধরে। ‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকে আমার অভিনীত অনিন্দ্য চরিত্রটি একজন প্রাক্তন স্বামী। চরিত্রটি মানুষ হিসেবে কিছুটা দুর্বল। স্ত্রীর প্রতি দিনের পর দিন খারাপ আচরণ করে। কর্পোরেটের ঝাঁ-চকচকে এক মহিলাকে তার পছন্দ হয়, এবং মনে করে সে-ই সেরা। কারণ, অনিন্দ্য তাকে উপর থেকে দেখে বিচার করেছিল। আর বাড়ির স্ত্রী, যে তার সংসার এবং সন্তানদের আগলে রেখেছে, তাকে অবজ্ঞা করেছিল। অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করেও শ্রীময়ী কিন্তু অনিন্দ্যের সংসারকে দুর্গের মতো রক্ষা করে। সন্তানেরা বাবার বিরুদ্ধাচরণ করলেও, মা কিন্তু তাদের সমর্থন করতে পারে না। ক্রমশ সেই মা-ও এক সময়ে নিজের মতো বাঁচতে শেখে।
‘চিরসখা’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্যে অপরাজিতা ঘোষ (বাঁ দিকে) এবং সুদীপ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
যে কোনও সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রয়োজনীয়। ‘চিরসখা’য় আমার অভিনীত চরিত্রের নাম স্বতন্ত্র। সে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে। এমন এক সম্পর্কে সে রয়েছে, যার হয়তো সামাজিক পরিচিতি নেই। কিন্তু সে একজন বিধবা মাকে সংসার আগলে রাখতে দেখছে। প্রয়োজনে সাহায্য করছে এবং অনুচ্চারিত রয়ে যাচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণ তো দ্রৌপ্রদীর সখা ছিলেন। অনেকটা সে রকমই। তিন সন্তানকে বড় করে তুলতে একজন মায়ের লড়াইয়ের অংশীদার স্বতন্ত্র। সে চায়, বৌঠান যেন নিজের শখ পূরণ করে। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। কমলিনী এবং স্বতন্ত্রের আখ্যান তো আমাদের চারপাশের দেখা মানুষদের থেকেই অনুপ্রাণিত। আমার মনে হয়, সময়ের ব্যবধানেও এই দুই মা কোথাও যেন এক। অর্থাৎ, মায়েদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হতে পারে। তিনি হতে পারেন আধুনিকা। তিনি সমাজে কোনও বৈপ্লবিক চিন্তাধারার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেন। তিনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু তাঁর একটাই পরিচয়, তিনি এক জন মা। এক জন বাবা হিসেবে দুনিয়াটাকে দেখি। তাই বলছি, সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা অপরিহার্য।
দেখেছি, বয়সকালেও গভীর মনখারাপের দিনে বা হয়তো অন্যকে না বলতে পারা কথা ভাগ করে নিতে হলে, সেই মাকেই প্রয়োজন পড়ে। তাই সব বয়সের মানুষের কাছেই মা, মা-ই হন। আর আমরা বাবা থেকে যাই।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)