ইসনটাগ্রামের নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত জীবন। ছবি: আইস্টক।
ছবি তুলেই ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার অভ্যাস আছে? আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করার বিষয় এলেই অধিকাংশ মানুষই ইনস্টাগ্রামের দ্বারস্থ হন। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজের কোনও এক মুহূর্ত বা সেই দৃশ্য ঘিরে নিজস্ব মতামত জানানোর এ এক অন্যতম মঞ্চ। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়াকেই এ বার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর বলে দাবি করছে নয়া গবেষণা।
রয়াল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইয়ং হেলথ মুভমেন্টের গবেষণা অনুযায়ী, মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিকর এই সোশ্যাল মিডিয়া। মানসিক অবসাদ তো বটেই, এমনকি মানসিক রোগের শিকারও হতে পারেন স্রেফ এই ইনস্টাগ্রামের সৌজন্যেই।
ইংল্যান্ডেরপ্রায় পনেরোশ টিন এজার ও দু’ হাজার জন ২০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের ঘুমের সময়, উদ্বেগ, হতাশা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা হয় এই সমীক্ষায়। এতেই দেখা যায় সারা দিনের সব কাজের বেলায় তো বটেই, এমনকি ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ (ফোমো)-এরও শিকার বেশির ভাগ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী মানুষ।
আরও পড়ুন: কমোডের চেয়ে বেশি জীবাণু স্মার্টফোনে!
কোন কোন সোশ্যাল মিডিয়া তাদের মানসিক গতিপ্রকৃতিতে এত বিচলন তৈরি করে তা জানতে গিয়েই উঠে আসে ইনস্টাগ্রামের কথা। এর পরেই দ্বিতীয় ক্ষতিকারক হিসাবে উঠে এসেছে স্ম্যাপচ্যাটের নাম।
ছবি তুলে নিমেষেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের অভ্যাস বাড়াচ্ছে মানসিক অবসাদ।
কী সমস্যা ইনস্টাগ্রামে?
ইনস্টাগ্রামে ছবি দেওয়া বা কোনও মুহূর্তকে বন্দি করে তা সারা বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে এক মানসিক শান্তি কাজ করে। সেখানে আসা লাইকের সংখ্যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ফেসবুকেও লাইক বা কমেন্টের চাপ থাকলেও আজকাল অনেকেই ফেসবুকের তুলনায় ইনস্টাগ্রামকে ছবি পোস্ট করার আরও বড় ও সুবিধাজনক মঞ্চ হিসাবে মানেন।
সেলিব্রিটিদেরও বেশির ভাগই ফেসবুকের ভিড় কাটিয়ে ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খোলেন। তাঁদের ফলো করার সুবিধার জন্যই হোক বা তুলনায় বেশি ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় গত কয়েক বছরে ইনস্টাগ্রামের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তা ছাড়া ছবি পোস্টের ক্ষেত্রে ছবি এডিট করার আলাদা অপশন, ছবি নকল করতে না পারার সুবিধাও এর বাড়তি পাওনা।
আরও পড়ুন: শরীরে এই সব লক্ষণ দেখা দিলেই সতর্ক হোন, ক্যানসার দানা বাঁধছে না তো?
বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপশন, দারুণ ফিল্টার-সহ হ্যাশট্যাগের এই দুনিয়াকে আপন করেন তাই অনেকেই। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গেল, ছবি এডিট করা থেকে সেই ছবিতে আসা নানা কমেন্ট বা ‘ভিউ’-এর অঙ্ক খুবই উদ্বেগে রেখেছে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও তাড়াতাড়ি ইনস্টাগ্রামে নিজের পোস্টের ভিউয়ার, লাইক বা কমেন্ট বা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। এমনকি অনেকেই মাঝ রাতেও ইনস্টাগ্রাম দেখার জন্য অ্যালার্ম দিয়েও রাখেন। সেখানে কোনও কারণে খারাপ মন্তব্য বা ভিউয়ার কম হলেই ইনস্টাগ্রাম নিয়ে বেশি মাত্রায় চিন্তায় থাকছেন অনেকেই।
অবস্থা কেবল সুদূর ব্রিটেনেই সঙ্গীন নয়, ইনস্টাগ্রাম নিয়ে একই রকম ভাবে মনের সমস্যায় ভুগছেন এ দেশের মানুষও। মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের মতে, ‘‘সমাজে নিজেকে নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা যে আমাদের ছবি, আমাদের মুহূর্ত— এগুলিকে যত ক্ষণ না পর্যন্ত বিশ্বজনীন করে তুলতে পারছি, তত ক্ষণ কোনও রকম মানসিক আরাম আমরা পাচ্ছি না। এ বার তা ব্যবহারের পর থেকে শুরু হয় তার লাইক-কমেন্টস বা ভিউ নিয়ে চিন্তা। ইনস্টাগ্রামে ছবিকে সুন্দর করে তুলতে সকলেই প্রায় ফোটো এডিট ব্যবহার করে থাকেন, যার মানেই আসল ছবিকে লুকিয়ে আরও উজ্জ্বল ও চটকদার কিছু প্রকাশ্যে আনা। এ থেকেই আত্ম সচেতনতা ও নার্সিসিস্ট এক মনোভাব প্রকাশ পায়।’’
আরও পড়ুন: পালক থেকে হাড়-মাংস সবই কালো এই মুরগির, গুণাগুণ জানলে আজই যোগ করবেন ডায়েটে
খেলনা নয়, ট্যাবেই বুঁদ শৈশব। ছবি: আইস্টক।
তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে, ‘‘ইনস্টাগ্রামে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য বা ভিউয়ার সংখ্যা কমে গেলে তা চাপ তৈরি করছে তরুণ প্রজন্মের মনে। এর চাপ এতই যে এর জেরে হাতাশা, মনের চাপ, মানসিক নানা রোগের শিকার হচ্ছেন মানুষ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠছে, এমনকি, ছবি লাইক না করায় পরিচিতদের মধ্যে সম্পর্কছেদও ঘটছে। ‘ফোমো’ বা ভার্চুয়াল জগৎ থেকে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদের। তাই ক্ষণে ক্ষণেই ইনস্টাগ্রাম খুলছেন তাঁরা। মানসিক বিকারের পর্যায়ে চলে যাওয়া এই আসক্তি এখনই রুখতে না পারলে তা ক্রমেই আমাদের এক ভার্চুয়াল জগতের ক্রীতদাসে পরিণত করবে। এক জন টিনএজারও এই ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার শিকার হতে হতে বড় হচ্ছে, ফলে তার বেড়ে ওঠাতেই থেকে যাচ্ছে গলদ।’’
করণীয় কী?
চিকিৎসকদের মতে, যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই সরে আসার পাঠ শিখতে হবে। যে মুহূর্তে নিজের ব্যক্তিগত কাজ বা মুহূর্তে থাবা বসাবে সোশ্যাল সাইট, তখনই সতর্ক হোন। প্রয়োজনে দিনে নির্দিষ্ট একটি সময়ের বাইরে একেবারেই অন করবেন না সোশ্যাল সাইট। মনের জোরেই এটা সম্ভব। অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হলে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
(ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন — ফিরে দেখা এই দিন।)