তারকামহল তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ত্বকের বলিরেখা, কুঞ্চন দূর করতে বোটক্স ইনজেকশনের ব্যবহার বাড়ছে। এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ
Lifestyle

বোটক্সে বন্দি বয়স

তারকামহল তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ত্বকের বলিরেখা, কুঞ্চন দূর করতে বোটক্স ইনজেকশনের ব্যবহার বাড়ছে। এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৭:২৪
Share:

আমির খানের মুখচোখে বয়সের ভাঁজ ছিল স্পষ্ট, ‘ফনা’ ছবির সময়ে। তার বছর তিনেক পরে তৎকালীন মধ্য চল্লিশের নায়ককে ‘থ্রি ইডিয়টস’-এ কলেজছাত্রের ভূমিকায় দেখা গেল। অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। তবে লক্ষ করেছিলেন, র‌্যাঞ্চোর চরিত্রে আমিরের মুখের বলিরেখা অনেকটাই উধাও। পত্রপত্রিকায় লেখালিখি হয়েছিল, অভিনেতার চামড়ার ভাঁজ মোছার অনেকখানি কৃতিত্বই বোটক্সের। অভিনয়, মডেলিংয়ের দুনিয়ায় টানটান তরুণ ত্বক ধরে রাখতে বোটক্সের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। তারকাদের দেখাদেখি এখন সাধারণ মানুষও বোটক্স ট্রিটমেন্টের সৌজন্যে লুকিয়ে ফেলছেন বেশ কয়েকটি বছর। তবে এই ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার।

Advertisement

বিজ্ঞান পুরস্কার

Advertisement

সৌন্দর্যশিল্পে বোটক্সের ব্যবহার কী ভাবে জনপ্রিয় হল, তা নিয়ে এক মজার কাহিনি শোনালেন চর্মরোগবিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধর। সহস্রাব্দের শুরুতে অস্কার পুরস্কারমঞ্চে তারকারা নাকি এক বিশ্রী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন। অনুশীলনে, পুরস্কার বিতরণীর দিনে অনেকক্ষণ ভারী ডিজ়াইনার পোশাক পরে থাকতে হত তাঁদের। এতে বাহুমূল ঘেমে উঠলে জনসমক্ষে তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট হত। ডিয়োডোরেন্ট, অ্যান্টি-পারসপিরেন্টে দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যেত না। শেষে বিশেষজ্ঞেরা বাহুমূলে বোটক্স ইনজেক্ট করার পরামর্শ দেন। এতে অন্তত ৪-৬ মাস ঘাম হত না।

ডা. ধর সহজ করে বললেন, ‘‘বোটক্স হল ডিপথেরিয়া গ্রুপের ব্যাকটিরিয়া বটুলিয়াম টক্সিন। ডিপথেরিয়া রোগের ক্ষেত্রে স্নায়ুর সমস্যা হওয়ার কথা শোনা যায়। আসলে ওই গ্রুপের ব্যাকটিরিয়ার নিউরো টক্সিসিটি আছে। এরা স্নায়ুর কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি নিউরোট্রান্সমিটারের (যার মাধ্যমে সংবেদন যায়) অ্যাসিটাইলকোলিনকে আটকে দেয়। ফলে ওই পেশিতে ফ্ল্যাক্সিড প্যারালিসিস (এক ধরনের অবশ ভাব) আসে। ওই অংশের পেশি সংকোচন-প্রসারণ করতে পারে না। এই অসুবিধেকেই বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে ব্যবহার করেছেন। এ-জি— সাত রকমের বটুলিয়াম টক্সিন আছে, তার মধ্যে এ এবং বি টাইপ দু’টিকে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিক ভাবে কোনও পেশিকে অবশ করতে এই প্রয়োগ চলে। স্নায়ুরোগে, চোখের মণি ঠিক জায়গায় না থাকলে বা চোখের পাতা নীচে পড়ে যাওয়ার অসুখে, মূত্রথলির রোগে বা প্রস্টেট বড় হয়ে গেলে বটুলিয়াম টক্সিন প্রয়োগ করা হয়। মাইগ্রেনে, এমনকি সেরিব্রাল পলসিতেও এটি কার্যকর। ২০১৬-য় এর প্রয়োগকে ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ছাড়পত্র দেয়। তবে ‘অফ লেবেল থেরাপি’তে (বিকল্প ক্ষেত্রে প্রয়োগ) তার আগেই বোটক্স ব্যবহার হত। তখনই মুখের পেশিকে টানটান রাখার প্রয়োজনেও সৌন্দর্যবিশ্বে বোটক্স ইনজেকশন জনপ্রিয় হয়ে যায়। অনেক বাচ্চার হাতে খুব ঘাম হয়, পেন পিছলে যায়। এই হাইপারাইড্রোসিসেও (অত্যধিক ঘাম) বোটক্স উপকারী। যে স্নায়ুর কারণে ঘাম হয়, তাকে অসাড় করে দেয়। আর পারফর্মিং আর্টে এর কদর তো আকাশছোঁয়া।’’

যৌবন বটিকা বোটক্স

পেশির সংকোচন-প্রসারণের জন্য বলিরেখা পড়ে। কপালে ভাঁজ, গালে রিংকলের ক্ষেত্রে যে স্নায়ুগুলো পেশিকে উদ্দীপিত করার জন্য পেশির কুঞ্চন হয়, সেটিকে বোটক্স ইনজেকশন দিয়ে প্যারালাইসড করে দেওয়া হয়। ফলে পেশি কুঞ্চিত হতে পারে না, ফ্ল্যাট (সমান) হয়ে পড়ে থাকে। চোখের কোণের ভাঁজে, গালে বলিরেখার অংশে এই ইনজেকশন দিলে আর ভাঁজ পড়ে না। ত্বক টানটান, তরুণ লাগে।

কনসালট্যান্ট ডার্মাটোলজিস্ট, কসমেটিক ও লেজ়ার সার্জন ডা. অভিষেক দে বললেন, ‘‘এক বার বোটক্স করালে প্রভাব থাকে ৬-৯ মাস। মাসল এরিয়াগুলি চিহ্নিত করে দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে প্রায় যন্ত্রণাহীন ভাবেই ইনজেকশন দেওয়া হয়। যেখানে বেশি রিংকল পড়ছে, সেখানে বেশি ইনজেকশন পড়ে। প্রক্রিয়ার আগে পরে ক্রিম লাগিয়ে দেওয়া হয়, তাতে ওই এলাকাটা অবশ থাকে। মুখের উপরের দিকে এক বার বোটক্স করতে খরচ মোটামুটি কুড়ি হাজারের মধ্যে।’’

নিরাপত্তার জন্য

আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? ডা. ধর বলছেন, বারবার বোটক্স করালে ফেশিয়াল মাসলস অফ এক্সপ্রেশনস আর কাজই করে না। তখন মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। মুখটা অস্বাভাবিক দেখানোর সম্ভাবনা থাকে। যিনি বোটক্স করাবেন, তাঁকে এই বিষয়টি বিশদে বোঝানো হয়, তাঁকে অনুমতিপত্রে সইও করানোর চল আছে। তবে দীর্ঘ দিন বোটক্স থেকে দূরে থাকলে মুখ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

ডা. দে বললেন, অনেক শিল্পী বা মানুষের এই পদ্ধতির প্রতি মোহ (বোটক্সফিলিয়া) জন্মে যায়। দু’-এক মাসের মধ্যে সামান্য রেখা দেখা দিলেও তাঁরা আবার অন্য কসমেটোলজিস্টের দ্বারস্থ হন। সমস্যার মূল কিন্তু সেখানেই। তবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চর্মরোগবিশেষজ্ঞের কাছে এখন এই পদ্ধতি নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে।

ডা. ধরের পরামর্শ, দীর্ঘ দিন এই ট্রিটমেন্টের সঙ্গে যুক্ত দক্ষ কসমেটোলজিস্ট বা কিউটেনিয়াস সার্জনের কাছে বোটক্স করানো উচিত। তা হলে ফলাফল নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।

কাজেই, বোটক্স করিয়ে সময়ের চাকা ঘোরানোর অভিপ্রায় থাকলে চোখকান খোলা রেখে, ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন