Christmas 2025

আলোর দেশের শিশু এল…

বাংলা ক্যারল, ভুলে যাওয়া পিঠে, হারানো পড়শির জন্য মন-কেমন। বাঙালির জিশু বরণের কাহিনি শোনালেন।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৩
Share:

— নিজস্ব চিত্র।

সে অনেক আগের এক ডিসেম্বরের কথা! বড়দিনে কেককে টেক্কা দিয়ে তালতলার বাতাসে পিঠের গন্ধের কথা লেখেন ফাদার দ‍্যতিয়েন। সাবেক পুব পাকিস্তানে খাস আঠারোগ্রামের মাইয়া মলিনা ভিনসেন্ট বললেন, “ওই সব পাকন পিঠে, পিরিচ পিঠে, কাটাকলির দিন গিয়াছে! কী করেই বা হবে, সে সব তো একা হাতে হওয়ার নয়!”

বাঙালি পিঠের এক জাতিভেদও একদা স্পষ্ট হত বড়দিন এলেই। পাটিসাপ্টা, দুধপুলি, আস্কে পিঠে তখনও কেতাদুরস্ত শহুরে ময়রার শোকেসে ঢোকেনি। কিন্তু কিছু পিঠে কলকাতা, মফস্স‌লের বাঙালি ক্রিশ্চান কলোনি বা মুসলিম পাড়ারই একচেটিয়া ছিল। মলিনা বলে চলেন, “তখন আগেভাগে ঠিক করা থাকত, অমুক দিন পাড়ার অমুকের বাড়ি পিঠে ভাজা হবে! ছোটবেলায় তো বটেই আমার বিয়ের পরেও তালতলার এ বাড়িতে মাসিশাশুড়ি লুইজ়া, রোজ়ি, টেরিজ়া কী মামিশাশুড়ি অ‍্যাগনেস, তস‍্য মেয়ে-বৌদের জমায়েতে চাঁদের হাট বসত।”

পাকন পিঠে ভাজতে এতগুলো হাত কেন লাগবে? ৮০ ছুঁই ছুঁই মলিনা বোঝান, এ পিঠে চালগুঁড়ির নয়। পাতলা ময়দার রুটির। “বেলে চটজলদি খাজিটা ভরে রুটিখান নৌকার আদলে কেটে নিতে হবে।” এক একটা রুটিতে চার-পাঁচটা পিঠে হয়। ভাজায় দেরি হলে রুটি শুকনো হবে। পিঠেও ভাল হবে না। মলিনা বলেন, “খাজি বুঝেছ! মানে পুর…স্টাফিং।” পিরিচ পিঠে মালপোর ধাঁচের। কাটাকলিও অনেকটা পাকনের মতো। তবে চালগুঁড়ির। ভিতরে নারকেল নয়, তিলবাটার খাজি। মনে পড়ল দেড় দশক আগে তখন ট‍্যাংরাবাসী তালতলার প্রবীণ গিন্নি আহ্লাদী রোজ়ারিওর ঘরের পাকন পিঠে, ধুবি পিঠের রকমারি চেখেছি, পুর বা স্টাফিংয়ের বাঙাল প্রতিশব্দ ‘খাজি’র সঙ্গেও তখনই পরিচয়।

মলিনা আর তাঁর আহ্লাদীদি, দু’জনেরই আঠারোগ্রাম কানেকশন। ঢাকার কাছে পদ্মার কোন শাখা নদী ইছামতীকে ঘিরে ১৮টি গ্রামেই নাকি আদি যুগের বাঙালি ক্রিশ্চানদের বসত। ভূষণার রাজপুত্র সতেরো শতকে মগ-বোম্বেটেদের হাতে ধরা পড়েন। চট্টগ্রামের পর্তুগিজ পাদ্রি তাঁকে উদ্ধার, লালনপালন করেছিলেন। ধর্মান্তরণের পরে রাজপুত্তুরের নাম হয় দোম আন্তোনিও দে রোজ়ারিও। শোনা যায়, বাগ্মী দোম আন্তোনিওর সংস্পর্শেই ঢাকার কাছের সেই আঠারোগ্রামে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ঝোঁক বাড়ে।

পর্তুগিজ ফাদারদের প্রভাবেই আদি যুগের বাঙালি তথা বাঙাল ক‍্যাথলিকেরা গোমস, রোজ়ারিও, ডিক্রুজ়, ডিকস্টা পদবিধারী। প্রোটেস্ট‍্যান্টরা অবশ‍্য অনেকেই বিশ্বাস, মণ্ডল, নস্কর পদবির। বিমল জোসেফ রোজ়ারিও বা প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস নামধারীরা আজও বিরল নন। এই ‘জাতে ভেতো’ বাঙালি খ্রিস্টানদের নামের সাহেবিয়ানা নিয়ে সরস লেখা লিখেছেন বেলজিয়ান ফাদার পল দ‍্যতিয়েন। নিজেকে মজা করে ‘উৎপল দত্ত রায়’ বলতেন ফাদার। বাংলা ভাষার টানে বঙ্গভূমিকে ভালবেসে এখানে থাকেন বেশ কয়েক দশক। উপনিবেশের হাত ধরে আসা খ্রিস্টীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে নিজের মাটির সংস্কৃতির মিশেলেই ‘খেশ্চানদের’ অনন্য বাঙালিয়ানা। দ‍্যতিয়েন থেকে মাদার টেরিজ়ার স্নেহধন‍্য মলিনা গির্জাঘরে রবিবাসরীয় মাস-কে ‘খ্রিস্টীয় যাগ’ বলতেই স্বচ্ছন্দ। তালতলার ডরোথি গোমস, তাঁর কন‍্যা অ‍্যাগনেস ওরফে চুমকি, ডরোথির ভাই জ়েভিয়ার রোজ়ারিওরা এক হলেও কাঠবাঙাল লব্জের জলতরঙ্গ বয়ে যায়। অ‍্যাগনেসের তরুণ পুত্র সাবধান করেন, “দয়া করে রাস্তাঘাটে শুদ্ধ বাংলা বোলো! এসআইআর হিড়িকে কোন আহাম্মক না তোমাদের বাংলাদেশি, ভেবে বসে!”

— নিজস্ব চিত্র।

সেন্ট পলস মিশন স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত অ‍্যাকাউন্টস শিক্ষক জ়েভিয়ার রোজ়ারিও ওরফে জীবন কয়েক বছর হল ঠাকুরপুকুরের বাসিন্দা। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে তালতলাতেই। এ ডিসেম্বরে ওঁর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতেই খোশগল্প জমল তালতলা বাজারে লটপাড়ার জয়দেব হাজরা বা কাঞ্চন বেকারির শেখ নুরুদ্দিনের সঙ্গে। মাঝ ডিসেম্বর থেকেই লাইন শুরু হয়েছে কাঞ্চন বা কাজল বেকারিতে। কেকের মালমশলা কারখানায় নির্দিষ্ট মাপ মতো পৌঁছে দিলেই মুশকিল আসান। শুধু কেকের পাউন্ডপিছু মেকিং চার্জ লাগবে। ওঁরা বলেন, কেক জ্বালাই করা। অ‍্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের বৌ বাঙালিনি সঞ্চিতা রিক্সনের রান্নার বিজ়নেস। ডেলিভারির সব কেক একা হাতে পারবেন না। তাই আগেভাগে কাজল বেকারির রুহুল আমিনের শরণাপন্ন।

বড়দিনের কেক তো বটেই, কলকাতার সেরা শীত-ফসল ছানার কেক থেকে নলেন গুড়ের কেকও মজুত আজকের তালতলায়। স্থানীয় লাকি বিবি মসজিদের (লোকমুখে লক্ষ্মী) বুজ়ুর্গরা বলেন, “জিশু তো আমাদেরও ঈশা নবি!” আরামবাগ লাইনের অগুনতি বাঙালি মুসলিম কারিগর ও বেকারি বাদ দিলে বাংলার বড়দিনের কেক নিয়ে হাহাকার পড়ে যাবে!

বাঙালি খ্রিস্টান বন্ধুরা কবরডাঙা, বেহালায় ছড়িয়ে পড়ছে বলে বিষণ্ণ পিডব্লিউডি কর্মী জয়দেব। ইদ, বিজয়ার কোলাকুলি, ছটে গঙ্গার ঘাটে যাওয়া, বড়দিনে গির্জায় শিশু জিশুর গোশালা দর্শন সবই এ তল্লাটের জীবনচর্যা। ঠিক যেমন তালতলা বাজারে রাজেশ খটিকের সসেজ দোকানে মা কালী ও জিশু বাবার পাশাপাশি অবস্থান। এই সসেজের কথা না জানলে বাঙালি খ্রিস্টানের বাঙালিয়ানা বোঝা যাবে না। যুগ যুগ ধরে কলকাতাবাসী ইউপির খটিকদের নানা কিসিমের গরম মশলায় সুরভিত সসেজে তেল, ঝাল, নুনের এক নিখুঁত ভারসাম্য। এর নাম এন্টালি সসেজ। অনেক বছর আগের এক ডিসেম্বরে এই তালতলার ভূমিপুত্র বন্ধুর নিমন্ত্রণে ভাত, পাতে সসেজ দেখে অবাক হয়েছিলাম। সসেজ তো পাউরুটির সঙ্গী জানতুম! সামান‍্য সর্ষের তেলে ভাজা মাংসের রসগোল্লা, ল‍্যাংচার মতো সসেজের তেলঝোল আলু দিয়েও গোগ্রাসে ভাত খান খ্রিস্টানেরা। জোর গলায় বলছি, ইলিশের তেল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ার স্বর্গীয় অনুভব থেকে তা কোনও অংশে কম নয়।

কিছু পুরনো পড়শির মতো ডিসেম্বরে বাজারে বড় বোয়াল মাছের অভাবেও মন খারাপ হয় মলিনার। খেশ্চান ঘরের সিগনেচার রান্না ভাজাকারি। লম্বাটে বেগুন, শীতের শিম, পেঁয়াজকলিযোগে বড় বোয়ালেই তা খোলে বেশি। ক্রিসমাস লাঞ্চে টম্যাটো দিয়ে মাছের কষা, পর্কের ভুনি, ভিন্দালু বা উৎসবের প্রাতরাশে ঘরোয়া চিকেন রোস্টের মতো এই ভাজাকারিও অপরিহার্য ছিল। ক্রমশ ছকে বাঁধা বিরিয়ানি, কষা মাংস, ফিশ ফ্রাইদের দখলদারি শুরু হয়েছে।

মলিনা ভিনসেন্ট। — নিজস্ব চিত্র।

ক্রিসমাস ইভ, বড়দিনে নিয়ম করে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে স্কুটারে ওয়েলেসলির ‘প্রভু যীশু গির্জা’য় ছুটতেন চিত্তরঞ্জন স‍্যামুয়েল রায়ও। সেন্ট জ়েভিয়ার্স স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক চিত্তদাই গির্জের কয়‍্যার মাস্টার। গোটা ডিসেম্বরটাই শিশু জিশুর আগমন কালের (অ‍্যাডভেন্ট সিজ়ন) গান, তার পর বড়দিন-গীতিতে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। এখনও একটু উস্কে দিলেই ধরবেন, ‘ও ভাই ত্রাণ দিতে জগতে এক বালক এসেছে’ বা ‘আলোর দেশের শিশু এল, আঁধার গেল দূরে’! ছোটবেলায় ক‍্যানিংয়ের স্কুলের মাস্টারমশাই নিকোলাস সিংহ, উপেন্দ্রনাথ মণ্ডলদের গান সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে চিত্তদার। এ ছাড়া সুনীল দত্ত, মানিক নাথ, প্রোটেস্ট‍্যান্ট গির্জার নির্মল পাণ্ডেদের অজস্র গান তো আছেই!

বহু যুগের ও-পারের ক্রিসমাস ইভে জাঁকালো শীত সন্ধ্যায় সবাইকে গির্জায় যাওয়ার জন‍্য জাগিয়ে রাখতে এ সব গানই ভরসা দিত। পাড়াগাঁয়ে তখনও কেক কাকে বলে, কেউ দেখেনি। বাড়ি বাড়ি গাইতে আসা ছেলেদের কোঁচড়ে ভরে দেওয়া হত মুড়ি-বাতাসা। উৎসবে যৌথতার স্মৃতিরা ভিড় করে। নবজাতকের দোলনা ঘিরে সজীব হয় হারানো সব চরিত্র। খিদে, প্রেম, আগুনের সেঁক নিতে চেয়ে জীবনের ঢেউয়ে একদিন লুটোপুটি খেয়েছিল যারা।

কৃতজ্ঞতা: সুরঞ্জন মিদ্যে(অধ্যাপক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়), রীতেশ সরকার (কলকাতা ডায়োসিস, সিএনআই)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন