ছবি প্রতীকী। তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য
নজর দেওয়া যাক ২০১১ সালের আদমসুমারির দিকে। তার হিসাবে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ১২১ কোটি, এর মধ্যে ৬২.৩১ কোটি পুরুষ। সংখ্যাটা গত প্রায় ৯ বছরে আরও কয়েক কোটি বেড়েছে। ভেজাল খাবার, পরিবেশ দূষণ, জীবনযাপনের ধরন বদলের মতো নানা কারণে পুরুষের রোগও বেড়ে চলেছে। এখনও আমাদের দেশে বেশির ভাগ পরিবারে পুরুষ সদস্যই যেহেতু একমাত্র রোজগেরে তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক জন পুরুষ অসুস্থ হওয়া মানে একটি পরিবারের উপর সমস্যার মেঘ নেমে আসা।
১. বন্ধ্যত্ব: পুরুষের সমস্যার কারণে ৪০-৫০ শতাংশ দম্পতি সন্তানহীন হয়। বহু পুরুষের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস পাওয়া, শুক্রাণুহীনতা, মিলনে অক্ষমতা-ইত্যাদি নানা রোগ দেখা যায়। পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত মদ্যপান, মানসিক চাপ, টানা রাত জাগা, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, চর্বিজাতীয় বা বাজার চলতি ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা, তামাক সেবন ইত্যাদি কারণে এই সব সমস্যা বেশি হয়। এ ছাড়া, শৈশবে ‘মামস’ বা গলার নীচের গ্রন্থি ফুলে জ্বর হওয়া, ক্রোমোজ়োমঘটিত রোগ যেমন ক্লাইন, ফিলটার সিনড্রোম প্রভৃতির জন্য শুক্রাণু কমে যেতে পারে। ক্যানসারজনিত রোগের কারণে শুক্রাশয় আক্রান্ত হতে পারে। যেমন, শুক্রাশয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যানসার দেখা দিলে বা অন্য কোনও অঙ্গের মেটাসস্টেসিস-এর ফলে শুক্রাশয় আক্রান্ত হতে পারে।
ড্যারিকোসিন নামক অণ্ডকোষের রোগ, সিলিয়াক ডিজিজ ইত্যাদি রোগের কারণেও শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বহু ক্ষণ ধরে সাইকেল চালানো, ঘোড়ায় চড়া, অতিরিক্ত তাপের সামনে বসে কাজ করা, (যেমন- ইঞ্জিনের সামনে বসে কাজ করা, রান্না করা) ইত্যাদি ক্ষেত্রেও শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যানসার রোগে ব্যবহৃত ওষুধ, পেশি তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত অ্যালকনিক স্টেরয়েড, সাইমেটাকিন নামক অম্বলের ওষুধ, গ্লাইরোকেল্যারুটোন নামক ওষুধ থেকেও পুরুষের বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
পুরুষের মিলনে অনিচ্ছার প্রধান কারণ হতে পারে ডায়াবেটিস, পিটুইটারি গ্লাণ্ডের টিউমার, রেট্রোপেরি টোনিয়াল সার্জারি, মেরুদণ্ডের আঘাত, হার্নিয়া অপারেশন। একাধিক গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের ব্যবহারে পুরুষের বন্ধ্যত্বের সমস্যা হতে পারে। তবে এর চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
ছেলেদের যৌন সমস্যার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে শীঘ্রপতন। পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুরুষ জীবনে কোনও না কোনও সময়ে যৌন সমস্যায় পড়ে থাকেন। এর বিপরীত একটি যৌন সমস্যা হল বিলম্বিত বীর্যস্খলন। স্নায়ুর আঘাত, কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, মানসিক চাপ প্রভৃতি কারণে এটি হতে পারে।
অনেক সময় বীর্যস্খলনের সময় বীর্য মূত্রনালী দিয়ে বের হওয়ার পরিবর্তে মূত্রথলীতে প্রবেশ করে। আবার পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে গেলে, মানসিক অবসাদ, দুঃশ্চিন্তা, মধুমেহ, অস্বাভাবিক রক্তচাপ প্রভৃতির ফলেও যৌন ইচ্ছা কমে যেতে পারে। ছেলেদের আরও একটি সমস্যা হল ধ্বজভঙ্গ বা লিঙ্গ শিথিলতা। এর কারণ মূলত হৃদরোগ, মধুমেহ, হরমোনের সমস্যা, স্নায়বিক দুর্বলতা, মানসিক উগ্বেগ, বয়সজনিত অসুখ, ধূমপান, ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, যৌনাঙ্গে আঘাত প্রভৃতি।
মেয়েদের মেনোপজের মতো ছেলেদেরও ‘অ্যান্ড্রোপজ’ হয়। এটি শুধু বয়স বাড়ার উপরেই নির্ভর করে না। ডায়াবেটিস, অবসাদ, দুর্বলতা, বিভিন্ন যৌন সমস্যার কারণে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন কমে গিয়ে অ্যান্ড্রোপজ হতে পারে। এতে অনেক পুরুষই অবসাদে ভোগা, উৎসাহ কমে আসা, অনিদ্রা, শুক্রাশয় ছোট হয়ে আসা, স্তন তৈরি হওয়া, শরীরের রোম ঝরে যাওয়া, যৌন মিলনে অনীহা, আত্মবিশ্বাসের অভাবের মতো সমস্যায় ভুগতে থাকেন।
ছেলেদের অনেকেই টাক পড়ার সমস্যায় ভোগেন। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধ করা, যোগব্যায়াম করতে হবে। এখন বিশেষ কিছু থেরাপি এবং হেয়ার গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে টাকের সমস্যার সমাধান করা হয়। রক্ত থেকে অনুচক্রিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত গ্রোথ ফ্যাক্টরও চুলে ব্যবহার করা হয়।
প্রস্টেটের সমস্যা নিয়েও বহু পুরুষ নাজেহাল। প্রস্টেট গ্রন্থি একটি গুরুত্বপূর্ণ সহকারী এক্সোক্রিন জননগ্রন্থি। এই গ্রন্থিটির আকার যখন ৩০ সিসির অধিক হয়ে যায় তখন তাকে বলে ‘প্রস্টোটোমেগালি’ বা প্রস্টেটের বৃদ্ধি। ষাট বা সত্তরের পরে শতকরা আশি ভাগ পুরুষ প্রস্টেটের কোনও না কোনও সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে অন্যতম প্রস্টেট ক্যানসার। ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া, প্রস্রাবের ধারা আটকে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হওয়া ইত্যাদি ক্যানসারের লক্ষণ।
প্রস্টেটের প্রদাহ অল্পবয়সী পুরুষদের মধ্যে পাওয়া যায়। অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন ওষুধ থেকে এটি ছড়ায়। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। প্রস্টেটের বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে পি এম এ নামক অ্যান্টিজেন কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে থাকে।
‘জার্নাল অফ ক্লিনিকাল অনকোলজি’তে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, মাথার সামনের অংশে এবং তালুতে চুল যাঁদের কমে যাচ্ছে তাঁদের প্রস্টেটে টিউমার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অনুলিখন : মনিরুল শেখ