হার্টের বাইপাস সার্জারির জন্য নামী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রৌঢ়। অস্ত্রোপচার সফল। দিন কয়েক পরে সেরে উঠে যখন বাড়ি যাওয়ার সময় হল, তখনই রক্তে ছড়াল সংক্রমণ। ডাক্তাররা জানালেন, ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’। বাড়ি ফেরা আর হল না তাঁর।
হাঁটুর ছোটখাটো অস্ত্রোপচার। শহরের এক নামী হাসপাতালেই হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর যে দিন বাড়ি ফিরলেন, তার পর দিনই জ্বর এল প্রৌঢ়ার। ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হল। জানা গেল, সেপ্টিসেমিয়া। হাসপাতাল থেকে পাওয়া ওই সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছিল তাঁরও।
দু’টি ঘটনার মধ্যে অন্তত ১০ বছরের ব্যবধান। মাঝের এই সময়টায় রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু যা বদলায়নি, তা হল সংক্রমণের চেহারা। আইসিইউ, আইটিইউ, লেবার রুম, সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ), বার্ন ইউনিট তো বটেই, সাধারণ ওয়ার্ডের শয্যাতেও সংক্রমণের ছড়াছড়ি। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের হালই কম-বেশি এক। সংক্রমণ ঠেকাতে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না প্রায় কেউই।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ বার উদ্যোগী হল জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন। এই প্রথম সরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গড়া হচ্ছে বিশেষ কমিটি। দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে কমিটির সদস্যদেরও। প্রথম ধাপে জেলা, মহকুমা এবং স্টেট জেনারেল হাসপাতালে এই কমিটি তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কমিটিতে হাসপাতালের সুপার, সহকারী সুপার, নার্সিং সুপার, এক জন সার্জন, প্যাথোলজিস্ট, অ্যানাস্থেটিস্ট, প্যাথোলজিস্ট থাকছেন। প্রত্যেকের দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশিকা আগেও ছিল। কিন্তু মানা হত না। কারও দায়িত্বও নির্দিষ্ট ছিল না। এখন সেটা হল। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। ফলে কেউই ‘জানি না’ বলে রেহাই পাবেন না।
এ রাজ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, “সংক্রমণ ঠেকানো যে কোনও হাসপাতালেরই প্রধান এবং প্রাথমিক কাজ। প্রথমে জেলা ও মহকুমা স্তরে বিষয়টি চালু হচ্ছে। পরে মেডিক্যাল কলেজগুলির ক্ষেত্রেও এটা চালু করা হবে।” জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের প্রাক্তন অধিকর্তা দিলীপ ঘোষও মনে করছেন, “দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হলে কাজটা ঠিকঠাক হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে যায়।”
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তা না মানা হলে কতটা সুফল মেলে, তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রথম দেখিয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগ। চিকিৎসক অরুণ সিংহের তত্ত্বাবধানে তৈরি হওয়া ওই ওয়ার্ডে কী ভাবে ন্যাতা দিয়ে ঘর মোছা হবে এবং সেই ন্যাতা কী ভাবে ধোয়া হবে সেটাও আলাদা করে শেখানো হত কর্মীদের। কখনও কোনও সাফাইকর্মী না এলে বিভাগের ডাক্তাররাই ওয়ার্ড সাফাইয়ের কাজে হাত লাগাতেন।
চিকিৎসকদের অনেকেই মানছেন এই সংক্রমণ, চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’ গোটা বিশ্বেই একটা বড় সমস্যা। বিশেষত কাউকে যদি টানা কয়েক দিন আইসিইউ বা আইটিইউ-এ থাকতে হয়, তা হলে পরিস্থিতি বহু সময়েই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ভিভিআইপি থেকে সাধারণ রোগী কারও রেহাই নেই। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, নার্সারি এবং লেবার রুমের রোগীদের ক্ষেত্রেও সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। একে বলা হয় ‘হেলথ কেয়ার অ্যাসোসিয়েটেড ইনফেকশন।’
হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ে কাজ করে যে সংস্থা, সেই হসপিটাল ইনফেকশন সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সদস্যরা জানিয়েছেন, যদি হাসপাতাল কর্মীরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাত ধোন, জীবাণুমুক্ত গাউন এবং গ্লাভস পরেন, রোগীদের পোশাক এবং বিছানার চাদর যদি ঠিকমতো পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, দু’টি শয্যার মধ্যে যথাযথ ব্যবধান থাকে, তা হলে এমন সংক্রমণের ভয় অনেক কমে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর যা চাপ এবং কর্মীর যা ঘাটতি, তাতে সমস্যা কী ভাবে মিটবে?
স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা মনে করছেন, সদিচ্ছাই বড় কথা। এক শীর্ষকর্তার কথায়, “অপারেশন থিয়েটার, লেবার রুম ইত্যাদি জায়গা থেকে সোয়াব সংগ্রহ করে ব্যাকটেরিয়ার চরিত্র জানার চেষ্টা সব সময়েই চলে। এ ক্ষেত্রে কোন সংক্রমণে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, সেটা ঠিক করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হল, বহু চিকিৎসকই গাইডলাইন না মেনে খুশিমতো অ্যান্টিবায়োটিক দেন। ফলে অনেকের দেহে ওষুধের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় পরিস্থিতি আগের তুলনায় উন্নত হতে বাধ্য। অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল মেনে ওষুধ দেওয়ার ব্যাপারেও জোর দেওয়া হবে।”
ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কোন পর্যায়ে রোগীকে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতি থাকার কথা সর্বত্রই। দেখা গিয়েছে, এক এক হাসপাতালে এক এক ধরনের সংক্রমণ বেশি। সেই অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক স্থির করা উচিত। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজির প্রধান চিকিৎসক বলেন, “কিছু অ্যান্টিবায়োটিক প্রথম পর্যায়ে দেওয়া যায়। আবার কিছু ‘রিজার্ভে’ রাখতে হয়। কালচার সেনসিটিভিটি টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার পরেই তা দেওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী, হাই ডোজের কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এগুলোর কথা জানেনই না অধিকাংশ চিকিৎসক।”
নতুন কমিটি তৈরির পরে বিষয়টি নিয়ে কতটা নাড়াচাড়া হয়, এখন সেটাই দেখার।