দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু হয়েও নারীদের দেখা নেই সংসদে। চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
সংখ্যালঘুদের সমস্যা কেবল সংখ্যা নয়, বরং ক্ষমতার খেলায়। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতে সংখ্যালঘু এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ সংক্রান্ত মন্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে চারদিকে।
‘নারীরা দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু, অথচ এখনও তাঁদের রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করা হল না কেন?’ প্রশ্ন তুললেন দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিভি নাগরত্ন। এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের একমাত্র মহিলা বিচারপতি। দাবি উঠেছে, সংসদে মহিলাদের অস্তিত্ব ক্রমশ কমে আসছে। ২০২৩ সালে পাস হওয়া ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম’ বা সংবিধানের ১০৬তম সংশোধনী আইনের কিছু ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর। এই আইন অনুযায়ী লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ মহিলা প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আইন পাস হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। আদালত জানিয়েছে, আইন প্রয়োগের দায়িত্ব সরকারের, আদালতের নয়। তাই সরকারকে নোটিস পাঠিয়ে জানাতে বলা হয়েছে, তারা কবে এবং কী ভাবে সংরক্ষণের বাস্তবায়ন শুরু করবে। এই ঘটনা নিয়ে সমাজচিন্তকদের মধ্যে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভাল-মন্দ নিয়ে কথা হচ্ছে সমাজের নানা স্তরে।
সংসদে মহিলাদের অস্তিত্ব ক্রমশ কমে আসছে। —ফাইল চিত্র।
যেমন, সংরক্ষণের আইন পাস হওয়ার দু’বছর পরেও হাতেকলমে কার্যকর হল না বলে আক্ষেপ রয়েছে আইনজীবী ঝুমা সেনের। তবে তিনি একই সঙ্গে আশাবাদীও বটে। কারণ এই মন্তব্য করে জবাবদিহি চেয়েছেন যিনি, সে ব্যক্তি, অর্থাৎ বিভি নাগরত্নের লড়াইকে কুর্নিশ জানান বাঙালি আইনজীবী। তিনি নিজেও যে ভাবে গোটা সুপ্রিম কোর্টে একা নারী হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তা অকল্পনীয়। ঝুমার কথায়, ‘‘সংরক্ষণের আইনকে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। কারণ, এটা মহিলাদের অধিকার। কিন্তু বিচারপতি নাগরত্ন এটাকে কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ করেছেন দেখে ভাল লাগল। পঞ্চায়েতে নারীদের আসন সংরক্ষণের আইন করে কিন্তু ভাল ফল মিলেছে। আশা করছি, সে রকমই সংসদেও নারীদের উপস্থিতি বাড়বে আর তাতে বাস্তব সমস্যাগুলো প্রকাশ্যে আসবে।’’
কিন্তু ঝুমার চিন্তা, সমস্ত ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনার এই চেষ্টাগুলি যদি শুধু প্রতীকী হয়েই থেকে যায়, তা হলে সমস্যা। আইনজীবীর কথায়, ‘‘আমি মনে করি, যদি অর্থবহ পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে, তা হলে প্রতীকী বৈচিত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। যে ভাবে এক জন হিন্দু, ব্রাহ্মণ মহিলা তাঁর সমস্যা বলবেন, যে ভাবে এক জন উচ্চবিত্ত নারী তাঁদের লড়াই তুলে ধরবেন, সে ভাবে দলিত বা আরও সংখ্যালঘুরও সংখ্যালঘু মুসলিম নারী অথবা প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচয়ের মেয়ে বলতে পারবেন না। মানে, সমস্যাগুলো প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আলাদা। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এই বক্তব্য প্রযোজ্য।’’ পাশাপাশি, ৩৩ শতাংশ নারীকে সংসদে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে, কতটা তাঁদের কথা শোনা হবে, সব নিয়েই সংশয়ে আইনজীবী ঝুমা।
বৈচিত্রের প্রতীকী হয়ে ওঠার দুশ্চিন্তা রয়েছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা আফরোজ়া খাতুনের মনেও। তিনি বলছেন, ‘‘মেয়েরা অবশ্যই সংখ্যালঘু। কিন্তু সব মেয়েকে এক সারিতে এক ভাবে রাখা যাবে না। এক জন দলিত মেয়ে, এক জন মুসলিম মেয়ে, এক জন ব্রাহ্মণ মেয়ে এক ছকে পড়বেন না। একই ভাবে অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ মেয়ে, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরও জায়গা ভিন্ন। সব জায়গার সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধি দরকার। এক এক জন এক এক ভাবে তাঁদের সম্প্রদায়, তাঁদের সমাজের কথা বলবেন। তেমনই এক জন পুরুষ আর নারী কোনও ভাবেই এক সারিতে বসতে পারেন না। এক নারীর সমস্যা এক জন পুরুষ বলবেন না। মেয়েদের কথা মেয়েরাই বলবেন। তাই নারীদের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। এবং সে ক্ষেত্রে নানা দিকের মেয়েরা থাকু্ন, এটাই চাই।’’ আফরোজ়ার প্রশ্ন, ‘‘সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু হয়েও মেয়েরা নেই কেন? তা হলে কি পিতৃতন্ত্র এটাই ভাবে যে, মেয়েদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই? মেয়েরা পারবেন না? কিন্তু পারার জন্য যে সুযোগসুবিধা দেওয়া দরকার, সেটাও তো দেওয়া হয় না তাঁদের। বদলে তাঁদের জায়গা দখল করে রেখে দেন পুরুষেরা।’’
ঠিক যে ভাবে ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েবসিরিজ়ে দেখানো হয়েছিল, মহিলা প্রধানের কেবল নামটাই ছাপানো হয় ব্যানারে, হোর্ডিংয়ে, কিন্তু বকলমে কাজ করে, গ্রামে ছড়ি ঘোরায় তাদের স্বামীরা, সে ভাবেই বাস্তব রাজনীতিরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের ছায়ার আড়ালে বসে আছেন পুরুষেরা। আর এই প্রসঙ্গেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যার অধ্যাপিকা ঐশিকা চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েতের মতো উদাহরণের পাশাপশি আমি এ-ও দেখেছি, মেয়েরা যখন সুযোগ পান, যখন তাঁরা ময়দানে নামেন, তাঁরা দেশের আর দশের কথা বেশি ভাল বোঝেন। তাঁদের বলতে দেওয়া হলে তাঁদের ক্ষমতা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। দেশ বলতে পুরুষেরা যদি বৃহত্তর রাজনীতি বোঝেন, মেয়েরা সেটা আরও ভাল বোঝেন, কারণ দেশের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ক্রীড়াক্ষেত্র তো মেয়েদেরই শরীর।।’’ কিন্তু রাজনীতিতে মেয়েদের আসা এবং থেকে যাওয়ার উদাহরণ তুলনায় কম। যে ভাবে থ্রি টিয়ার সিস্টেমের মাধ্যমে মেয়েদের অংশগ্রহণকে কার্যকরী করার প্রয়াস হয়েছিল, সেখানেও দেখা গিয়েছে, হয়তো সংরক্ষিত আসনে মেয়েরা আসছেন, কিন্তু কারও প্রক্সি হয়ে। তবে তার পরেও নিজের জোরে রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়ানো মেয়ের উদাহরণ অনেক আছে। তবে ঐশিকার আক্ষেপ, এর পরেও সুপ্রিম কোর্টকে আলাদা করে নির্দেশ দিতে হচ্ছে আইন কার্যকর করার জন্য।
বিচারপতি বিভি নাগরত্ন। —ফাইল চিত্র।
এই পরিস্থিতির নেপথ্যে আসলে কেবল সংখ্যা নেই। আছে ক্ষমতার রাজনীতি আর প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি। আর তাই মনোসামাজিক কর্মী রত্নাবলী রায় বলছেন, "সংসদে নারীদের অনুপস্থিতি তো কেবল নারীদের ইস্যু নয়। এটা নীতিনির্ধারণের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গার্হস্থ্য হিংসা ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রের চেহারা বদলে যাবে নারীদের উপস্থিতি বাড়লে। তাই এই আইনের মাধ্যমে নারীদের এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে, এ সব কিছুই নয়। আসলে ক্ষমতার সমবণ্টন প্রয়োজন। আর এটার মাধ্যমে সেটাই হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি আমরা।’’
রাষ্ট্রগঠনে নারীদেরও সহনির্মাতা হতে হবে। কেবল নারী কেন, যে কোনও প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষকেই সেই জায়গাটা দিতে হবে। তাই সংসদে মহিলা প্রতিনিধিদের সংখ্যা কম থাকার ঘটনায় উদ্বেগের বিষয় কেবল সংখ্যা নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বা কেন্দ্রীকরণই আসলে দুশ্চিন্তার। আর এই সংরক্ষণ যদি হয় সেই পরিবর্তনের সূচনা, তা হলে এই আইন কার্যকর করতে হবে, বাস্তবায়িত করতে হবে।