লিভার ও কোমরই বলে দেবে, হৃদ্‌যন্ত্র কেমন

লিভারে কতটা ফ্যাট জমল এবং কোমরের বেড় কতটা বাড়ল— এই দু’টি শারীরিক অবস্থা বলে দিতে পারে, কোনও ব্যক্তি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হবেন কি না। এমনই দাবি করেছেন গবেষকেরা। আর এই গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে কয়েক জন বাঙালি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর নাম।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর ও সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২১
Share:

লিভারে কতটা ফ্যাট জমল এবং কোমরের বেড় কতটা বাড়ল— এই দু’টি শারীরিক অবস্থা বলে দিতে পারে, কোনও ব্যক্তি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হবেন কি না। এমনই দাবি করেছেন গবেষকেরা। আর এই গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে কয়েক জন বাঙালি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর নাম। জড়িয়ে গিয়েছে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এ়ডুকেশন এবং রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর নামও।

Advertisement

কলকাতার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এই গবেষণায় হাত হাত লাগিয়ে কাজ করেছেন আমেরিকার ‘ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল’-এর বিজ্ঞানীরা। ওই গবেষণাপত্রটি ইতিমধ্যেই ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কার্ডিওলজি’-তে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে। ওই গবেষণাপত্রের লেখকদের দাবি, ফ্যাটি লিভার, কোমরের বেড় এবং ক্যারোটিড ধমনীর দেওয়াল পুরু হওয়া— এই তিনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। যদি কারও ফ্যাটি লিভার থাকে এবং গলার ক্যারোটিড ধমনীর দেওয়াল পুরু হয় তখন সেটা বেশি চিন্তার। সে ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার

এবং কোমরের চওড়া বেড়ের সহাবস্থান ঘটলে ক্যারোটিড ধমনীর পরীক্ষাটাও করে নেওয়া দরকার। যদি দেখা যায় দেওয়াল পুরু, তা হলে হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা যথেষ্ট বেশি।

Advertisement

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য, কলকাতার আইপিজিএমইআর-এর অধীন ‘স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজিজেস’-এর চিকিৎসক, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী জানান, বীরভূমের চারটি ব্লকের ৪৬৯১ জন মানুষের রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি লিভার ও ক্যারোটিড ধমনীর আলট্রাসোনোগ্রাফি করা হয়। মাপা হয় ওজন, রক্তচাপ, উচ্চতা, কোমর এবং নিতম্বের বেড়। এই সব শারীরিক পরিমাপ থেকে হৃদ্‌রোগের পূর্বাভাস পাওয়ার চেষ্টা করা হয়।

অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শারীরিক পরিমাপগুলোর মধ্যে নিবিড় যোগ থাকছে। একটি বাড়লে অন্যগুলোও বেড়ে যাচ্ছে। সেটাই নজরে রাখা জরুরি।’’

গবেষকেরা দেখেছেন, বীরভূমের ওই সব মানুষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম স্থূলত্বেই হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা বাড়ছে। এক গবেষকের কথায়, ‘‘উন্নত দেশগুলোতে যে সব সমীক্ষা হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে, স্থূলত্ব বাড়লেই হৃদ্‌রোগের শঙ্কা বাড়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম স্থূলত্বেই হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।

কেন এমন হচ্ছে, সেটাই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। বীরভূম এ ক্ষেত্রে শুধু একটা নাম। দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনও জায়গাতেই

এমন ফল মিলতে পারত।’’

অভিজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, দক্ষিণ এশিয়াকে বলা হয় হৃদ্‌রোগের রাজধানী। বহু গরিব মানুষও এখানে মারা যান হার্টের অসুখে। এর কারণ কী তা যাচাই করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, যাঁরা বাইরে থেকে দেখতে মোটা তাঁদেরই যে এই ঝুঁকি রয়েছে এমন নয়। বাইরে থেকে রোগাসোগা, অথচ অল্প ভুঁড়ি রয়েছে, এমন অনেকেরই ফ্যাটি লিভার রয়েছে। ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার এবং হৃদ্‌রোগ পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, ‘‘বীরভূমের ওই তথ্য নিয়ে ভারতীয় গবেষকদের সঙ্গে গবেষণা করেছেন মার্কিন গবেষকরাও। দেখা গিয়েছে, সে দেশে যেমন ম়ূলত বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দিয়েই ‘ফিটনেস’-এর যাচাই হয়, এখানে তা নয়। অপেক্ষাকৃত রোগা লোকজনেরও এখানে ফ্যাটি লিভার। শুধু ফ্যাটি লিভার নয়, ক্যারোটিড ধমনীর দেওয়ালও পুরু।

গবেষকদলের আর এক সদস্য, চিকিৎসক পিনাকপাণি ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা, ‘‘১০ বছর আগে ১০ জনের আলট্রাসোনোগ্রাফি করলে দু’জনের ফ্যাটি লিভার পেতাম। আর এখন ১০ জনের মধ্যে দু’জনকেও সুস্থ পাই কি না, সন্দেহ।’’

এমন দ্রুত হারে বাড়লেও এখন পর্যন্ত ফ্যাটি লিভারকে নিরীহ অসুখ বলে মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০০ জনের মধ্যে ৯০

জনের এ নিয়ে কোনও সমস্যা হয়

না। কিন্তু ১০ জনের হয়। কাদের সেটা হবে, তা বোঝার জন্য বাকি দু’টি মাপকাঠি দেখে নিতে হবে। কারণ বাকি দু’টিও যদি মিলে যায়, তা হলে পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে বড়সড় সমস্যা হতে পারে।

কার্ডিওলজিস্ট শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ফ্যাটি লিভার তো আলট্রা সোনোগ্রাফি করলে সহজেই ধরা পড়ে। অনেকেই সেটা পাত্তা দেন না। গবেষণায় যদি ফ্যাটি লিভারের সঙ্গে বাকি দু’টি মাপকাঠির যোগাযোগের ক্ষতিকারক দিকটা প্রমাণিত হয়, তা হলে হৃদ্‌রোগ আগেভাগে ধরে ফেলা বা সতর্ক থাকার পক্ষে তা যথেষ্ট

কাজে লাগবে।’’

এ বার থেকে হার্টের হালহকিকত বুঝতে কি তা হলে লিভারকেও চোখে-চোখে রাখতে হবে?

কার্ডিওলজিস্টরা বলছেন, অবশ্যই! কার্ডিওলজিস্ট বিশ্বকেশ মজুমদারের কথায়, ‘‘হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে হার্ট ফেলিওর— সবেতেই লিভারের যোগ। যেমন, ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভার বড় হলে ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে যায়। আবার ফ্যাটি লিভার না হওয়া সত্ত্বেও লিভার বড় হতে পারে, যদি হার্ট ফেলিওর হয়ে থাকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন