রোগ নির্ণয়ে বিলম্বের কারণে ক্যানসার যে প্রায়শই মারমুখী হয়ে উঠছে, তাতে সংশয়ের অবকাশ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রোগীর গাফিলতি বা সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসক মহলের একাংশেরও কি কোনও দায় থেকে যাচ্ছে?
ইদানীং নানা মহলে প্রশ্নটা উঠছে। অনেকেরই বক্তব্য: জেনারেল ফিজিশিয়ান কিংবা ক্যানসার ছাড়া অন্য রোগের বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ গোড়ায় রোগটা ধরতে পারছেন না। চিকিৎসকদের একাংশ এই অভিযোগ মেনে নিলেও আর এক মহলের অবশ্য দাবি, ধারণাটা সম্পূর্ণ অমূলক।
তবে ক্যানসার-চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন, এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে ক্যানসার সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য থাকা প্রয়োজন। ওঁদের মতে, পাঁচ বছরের এমবিবিএসে ক্যানসার সম্পর্কে পড়ুয়াদের জ্ঞান সঞ্চয় হয় সামান্যই। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের উপসর্গ সম্পর্কে জানার সুযোগ কম। ফলে বহু ক্ষেত্রে রোগীকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিতে তাঁরা দেরি করে ফেলছেন। এমবিবিএসে ক্যানসার সংক্রান্ত তথ্য আরও বিশদে রাখার দাবি জানিয়ে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-কে লিখিত আবেদনও জানিয়েছে ক্যানসার-চিকিৎসকদের একাধিক সংগঠন।
ইতিমধ্যে ডেন্টাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র শেষ কার্যনির্বাহী সমিতির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিডিএস পাঠ্যক্রমে তামাকের ব্যবহার ও তার জেরে মুখের ক্যানসারের বিষয়টি ঢোকানো হবে। প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকে পাঠানো হয়েছে। নতুন পাঠ্যক্রমের খসড়াও তৈরি বলে জানিয়েছেন কাউন্সিলের কর্তারা। প্রসঙ্গত, বিশ্বে ফি বছর মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্তদের বড় অংশ ভারতীয়। এ-ও প্রমাণিত যে, তামাকই এর মূল কারণ। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “মুখের ভিতরে কিছু হলে লোকে সাধারণত প্রথমে দাঁতের ডাক্তার দেখান। তাই ডেন্টিস্টরা ক্যানসারের পূর্বাভাস পেলে গোড়াতেই প্রতিরোধের চেষ্টা করতে পারেন।” এমসিআই কী ভাবছে?
এমসিআইয়ের এক শীর্ষ অ্যাকাডেমিক উপদেষ্টা বলেন, “এমবিবিএসে পাঠ্যক্রমের চাপ নিয়ে এমনিতেই বিস্তর অভিযোগ। সিলেবাসের কলেবর বাড়ালে আরও অভিযোগ আসবে। তাই এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।” তবে শিক্ষক-চিকিৎসকদের মধ্যে কর্মশালা করার কথা ভাবা হচ্ছে। “দেখা হচ্ছে, বর্তমান সিলেবাসের মধ্যেই কী ভাবে তাঁরা ক্যানসার সম্পর্কে আরও ভাল ভাবে পড়াতে পারেন।” মন্তব্য ওই কর্তার।
ক্যানসার সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায়ও মনে করছেন, এমবিবিএস পাশ করার পরে ডাক্তারদের জন্য ক্যানসার-কর্মশালার আয়োজন খুবই জরুরি। তিনি জানিয়েছেন, কলকাতার এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অফিসারদের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। যদিও পরে নানা কারণে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, এমবিবিএসে বিক্ষিপ্ত ভাবে ক্যানসার সম্পর্কে পড়ানো হয়। আর একটু বিস্তারিত থাকা উচিত ছিল। “আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজে ছাড়পত্রের ক্ষেত্রে ক্যানসার বিভাগ থাকা আবশ্যিক শর্ত করা জরুরি। তা হলে পড়ুয়ারা হাতে-কলমে রোগীদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাবে। শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হবে।” বলছেন তিনি।
ভিন্ন মতও রয়েছে। কী রকম?
চিকিৎসকদের একাংশ চাইছেন, সিলেবাসের চাপ না-বাড়িয়ে পড়ানোর ধরনে যথাযথ পরিবর্তন আসুক। ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষের বক্তব্য, “কেউ যদি এসে বলেন প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরোচ্ছে, অথচ যন্ত্রণা নেই, তা হলে দেখতে হবে ক্যানসার কি না। শুরুতেই আলট্রাসোনোগ্রাফি। আবার পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষের প্রস্টেট-পরীক্ষায় হয়তো দেখা গেল, গ্ল্যান্ড শক্ত। সেখানেও নিশ্চিত হতে হবে, ক্যানসার কি না। এই ব্যাপারগুলো কচি মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলেই যথেষ্ট।” গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর প্রশ্ন, “এমবিবিএসে সিলেবাস বাড়িয়ে কী হবে? ক’জন ডাক্তার এখন রোগী ঘাঁটেন যে, উপসর্গ দেখে বুঝতে পারবেন কোনটা কী রোগ? ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পাট তো প্রায় উঠেই গিয়েছে!”
ফলে রোগী দেখে, সমস্যার কথা শুনেও বহু ডাক্তার কিছুই আঁচ করতে পারছেন না বলে আক্ষেপ করেছেন অনেক চিকিৎসক। শল্য চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, এমবিবিএসে ক্যানসার সম্পর্কে আরও বেশি পড়ানোর প্রস্তাব অর্থহীন। তাঁর মন্তব্য, “এ ভাবে চলতে থাকলে তো হার্ট, এইচআইভি সমস্ত কিছুর জন্যই পাঠ্যক্রম বাড়ানোর প্রস্তাব উঠবে!” কৃষ্ণেন্দুবাবুর বক্তব্য, “বরং প্রাথমিক স্তরে যাঁরা চিকিৎসা করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো জরুরি। বিকল্প চিকিৎসা করতে গিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট যাতে না-হয়, সে ব্যাপারে আরও প্রচার দরকার।”
প্রাক্তন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অনিরুদ্ধ করের আক্ষেপ, কমিউনিটি স্তরে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্যানসার-সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা তাঁরা শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পারেননি। তিনি বলেন, “পরিকল্পনা ছিল, ব্লক স্তরে অন্তত রোগ নির্ণয়টা শুরু হোক। ছ’টা জেলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বেশ ক’বার কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকেরা গিয়ে তালিম দিয়েছিলেন। পরে আর কিছুই এগোয়নি।” কেন এগোয়নি, তার ব্যাখ্যা অবশ্য রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য-কর্তারা দিতে পারেননি।
বস্তুত সচেতনতার অভাবটা যে সমাজের পরতে-পরতে জড়িয়ে, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করা এক মানুষই তা জানিয়েছেন। তিনি অজয় গুপ্ত। বর্ষীয়ান অজয়বাবু নিজের ‘রোগযাত্রা’র অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বইও লিখেছেন। এবং জানাচ্ছেন, “ক্যানসার নিয়ে ভয় দেখানোর প্রবণতাটাই সবার আগে বন্ধ করা দরকার। ক্যানসারকে মারণ রোগ বলা হবে কেন? চিকিৎসা না-করালে যে কোনও রোগই তো মারণ!” ওঁর মতে, ক্যানসারের প্রধান শত্রু হল নিঃসঙ্গতা। এখনও কলকাতা শহরেই ক্যানসার-রোগীকে একঘরে করে রাখে বহু পরিবার। সেই সচেতনতাটা তৈরি করাই সবচেয়ে জরুরি। আরও জরুরি হল, ওষুধের দাম কমানো।
না-হলে রোগ ধরা পড়লেও চিকিৎসা যে হবে না!
(শেষ)