মৃতদেহ ছুঁলে তাঁদেরও রোগ হয়ে যাবে— এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে যক্ষ্মায় মৃত এক যুবকের দেহ নিতে চাইছেন না তাঁর পরিজনেরা।
গত ১৭ অগস্ট যাদবপুরের কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে সুনীল গুড়িয়া নামে বছর সাতাশের এক যুবকের মৃত্যু হয়। বাড়ির লোক প্রত্যাখ্যান করায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তাঁর মৃতদেহ পড়ে আছে বাঙুর হাসপাতালের মর্গে।
যক্ষ্মা নিয়ে এত প্রচার সত্ত্বেও এখনও এই পর্যায়ের ভ্রান্ত ধারণায় বিচলিত স্বাস্থ্যকর্তারা। যক্ষ্মা যে ছুঁলে হয় না, হাঁচি-কাশি-কফ থেকে ছড়ায়, তা লাগাতার প্রচার হচ্ছে। তাতেও যে সাধারণ মানুষ-সহ বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর বস্তাপচা ধারণা ভাঙছে না, তা স্বীকার করছেন পার্থসারথি ভট্টাচার্য, তরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অংশুমান মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশেষজ্ঞেরা।
সব চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর। এই দেহের সৎকার কী ভাবে হবে, তা নিয়ে রীতিমতো বিভ্রান্ত সেখানকার কর্তারা। আইনত পরিচয়হীন, আত্মীয়হীন দেহ বেওয়ারিশ হিসেবে সৎকার করে দিতে পারে সরকার। কিন্তু মৃতের পরিবারের লোকজন থাকলে সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে দেহের শেষকৃত্য করতে পারে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা যদি বাড়ির লোককে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারে, ভাল হয়। না হলে বাড়ির লোকের থেকে দেহ সৎকারের লিখিত অনুমতি আনা হবে, নাকি আদালতের দ্বারস্থ হবে স্বাস্থ্য দফতর, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।”
গত ১৫ জুলাই কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হন পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটার বাসিন্দা সুনীল। তিনি ‘মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। অর্থাৎ, যক্ষ্মার প্রচলিত ওষুধ তাঁর দেহে কাজ করছিল না। ১৭ অগস্ট তিনি মারা যান। মৃতের বাড়ির লোক বলতে দাদা আর বৌদি। বাবা-মা মারা গিয়েছেন। দাদা নিতাই গুড়িয়ার বক্তব্য, “ভাই ভবঘুরে ছিল। ওর যক্ষ্মার কথা যখন জানলাম, তখন থেকেই সিঁটিয়ে রয়েছি। ভাই কোনওদিন বাড়ি এলেই শরীরে জীবাণু ঢুকে যাওয়ার ভয়ে বৌ-মেয়েকে নিয়ে পাশের বাড়ি পালিয়ে যেতাম।” বলেন, “ওই দেহ আমি ছুঁতে পারব না কিছুতেই। আমার রোগ ধরবে। বৌ-মেয়ে পথে বসবে।” তা হলে তিনি স্বাস্থ্য দফতরকে দেহ সৎকারের লিখিত অনুমতি দিচ্ছেন না কেন? নিতাইয়ের উত্তর, “আমরা গরিব মানুষ। সইসাবুদ করে মরব নাকি! তার পরে আমাদের থানা-পুলিশ, আদালতে দৌড়তে হবে। যা করার হাসপাতাল বুঝে নিক।”
আগে কি এমন সমস্যায় পড়েনি স্বাস্থ্য দফতর? বাম আমলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “ঠিক মনে পড়ছে না। তবে বাড়ির লোক দেহ নিতে না চাইলে তাঁদের লিখিত অনুমতি নিয়ে সৎকার করাই শ্রেয়।”
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, পরে যদি বাড়ির লোক অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য দফতর তাঁদের চাপ দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, তখন? মেডিকো-লিগাল বিশেষজ্ঞ শেখর বসু, নিশীথ অধিকারীরা মনে করেন, সে ক্ষেত্রে পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতর, মৃতের বাড়ির লোক, স্থানীয় পঞ্চায়েত-প্রশাসন, গ্রামের লোককে নিয়ে আলোচনায় বসে সকলের সই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) ডিজি বাণীব্রত বসু অবশ্য জানিয়েছেন, কর্মজীবনে কয়েক বার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তখন ৭-১০ দিন সেই দেহ মর্গে রেখে পুলিশ সৎকার করে দিয়েছে। কারণ, এর পরে পচন ধরতে শুরু করে। আবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষের কথায়, “দাবিহীন মৃতদেহ সৎকারের আইন বাতলানো আছে। কিন্তু পরিচয়যুক্ত মৃতদেহের ক্ষেত্রে কী করা উচিত, সে আইন আমাদের হাতে নেই।” তাঁর আরও বক্তব্য, “বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এমন সমস্যায় পড়তে হয়। এর পিছনে আর্থিক কারণও থাকে। এ ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছে, খতিয়ে দেখা দরকার।”