দৃশ্য এক: মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশনের ফুটপাথ। কাঠফাটা রোদেও বিরিয়ানির দোকানে ‘ঠাঁই নাই’ রব। তুমুল গরমের মধ্যেই বসে খাচ্ছেন একদল পুরুষ ও মহিলা। যাঁদের বসার জায়গা জোটেনি, দাঁড়িয়েই সাবাড় করে ফেলছেন প্লেটভরা বিরিয়ানি। পার্সেলেও লাইন। এক প্লেট মাটন বিরিয়ানি চাইতেই দোকানদার বললেন, “সকাল দশটা থেকে ছ’হাঁড়ি শেষ। আরও দু’হাঁড়ি আনতে পাঠিয়েছি। অপেক্ষা করতে হবে।” ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো।
দৃশ্য দুই: বিকেল পাঁচটা। গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে তেলেভাজার দোকানে উপচে পড়া ভিড়। ঠায় দাঁড়িয়ে অনেকের মুখে বিরক্তি। কেউ কেউ দোকানদারকেও তাড়াও দিচ্ছেন, “আমার বেগুনি, পেঁয়াজিগুলো কী হল? আর কতক্ষণ?” জবাব মিলছে, “একটু দাঁড়ান দাদা! দেখছেন তো কত লোক। সবাইকে দিতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে কি হবে!”
দৃশ্য তিন: কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে কচুরির দোকান। পাওয়া যায় জিলিপি, অমৃতি, গজা, লাড্ডুও। সন্ধে সাতটার সময়ে কিছু আছে কি না জিজ্ঞাসা করতেই দোকানদার হেসে ফেললেন ‘‘সব শেষ দাদা! আবার কাল।” ফুটপাথের উপরে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে বাসনপত্র মাজা।
টালা থেকে টালিগঞ্জ, সেক্টর ফাইভ থেকে বেহালা— এলাকা বদলায় শুধু। ছবিটা সেই এক— ফুটপাথ জুড়ে সকাল থেকে রাত হরেক খাবারের পসরা। খিচুড়ি থেকে পোলাও, ফিশফ্রাই, কাটলেট, মোমো, চাউমিন, নানা ধরনের রোল থেকে ডালের বড়া— বাদ নেই কিছুই। সেই সঙ্গে কাটা ফল, রঙিন সরবতের ঢালাও বিক্রি তো আছেই। দোকানদারেরা জানালেন, ক্রেতারা নিজেরা তো খান-ই, অনেকে আবার নিয়ে যান বাড়ির লোকেদের জন্যও।
খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রাস্তার বিক্রি হওয়া এ সব খাবারে ক্যালোরি এবং প্রোটিন থাকলেও ঝুঁকির দিকটাই বেশি। এই ধরনের খাবারে অত্যন্ত নিম্ন মানের উপাদান ব্যবহার করা হয়। ক্রেতাদের আকর্ষণের জন্য মেশানো হয় নানা ধরনের রাসায়নিক রং। যা থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অভিযোগ, এই ধরণের খাবার যাঁরা বিক্রি করেন, তাঁদের একটা উদ্দেশ্য হল কম খরচে বেশি লাভ করা। তাই তাঁদের পক্ষে খাবারের গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না। খাবার তৈরিতে দিনের পর দিন একই তেল ব্যবহার করেন। রাস্তায় ফেলে একই জলে বাসনপত্র ধোয়া হয় বারবার। খাবার তৈরির সময়েও অপরিশোধিত জল ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এই সব খাবারের উপাদান হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ভেজালও মেশানো হয় বলে অভিযোগ। খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সব খাবার যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের কাছে স্বাদই গুরুত্ব পায়। স্বাদ বাড়াতে গুণাগুণ বিচার না করেই রান্নায় বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়। যার মান কোনও সময়েই বিচার করা হয় না বলে অভিযোগ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক উৎপল রায়চৌধুরী বলেন, “আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখন কম বয়সীদের মধ্যে হৃদ্রোগ, পেটের অসুখ, ক্যানসার, স্ট্রোক, স্নায়ু রোগের প্রবণতা বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সবের জন্য দায়ী আমাদের খাদ্যাভ্যাস। কারণ এগুলো খাদ্যবাহী রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে এর বিপদ নিয়ে সতর্কও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সচেতন হইনি।”
নিয়মিত বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ফুটপাথের খাবার দিয়েই খাওয়া সারেন সরকারি কর্মী সুশীল রায়। বললেন, ‘‘বহু বার পেটের অসুখ হয়েছে। তবু ফুটপাথের খাবার ভালবাসি।” ক্যামাক স্ট্রিটের ফুটপাথে রোজ বিকেল টিফিন করেন বেসরকারি ব্যঙ্কের কর্মী মৌমিতা চক্রবর্তী। তিনি বলেন “সমস্যা তো হয়ই। তখন অ্যান্টাসিড খেয়ে নিই।”
খাদ্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকদের মতে, ফুটপাথের খাবারের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা তীব্র আকর্ষণ থাকে। তার থেকেই এই ধরনের খাবার খাওয়াটা নেশার মতো হয়ে যায়। চটজলদি পাওয়া যায় বলে মানুষ তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। রাস্তার খাবার খাওয়াটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে এই ধরনের খাবারের বিপদ সর্ম্পকে মানুষকে সচেতন করেও কোনও লাভ হয় না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এ সমস্ত খাবার খুব ঝুঁকির। তবুও অনেকে বাড়ির বাচ্চাদেরও পর্যন্ত এই খাবারে অভ্যস্ত করে তোলেন।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কমলেন্দু চক্রবর্তী বলেন, “এখন অনেক শিশু ছোটবেলা থেকেই মোটা হয়ে যেতে শুরু করে। বাচ্চাদের ‘ওবেসিটি’ এবং কৃমির উপদ্রবের জন্য নব্বই শতাংশ দায়ী রাস্তার খাবার। বাড়ির বড়রা যা খান, তার প্রভাব বাচ্চাদের উপরেও পড়ে। এই সব খাবারের জন্য বাড়ির বাচ্চাদেরও বড়দের মতো হৃদ্রোগ, পেটের অসুখ, ক্যানসার, স্ট্রোকের মতো রোগ হতে পারে।”
এসএসকেএম হাসপাতালে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের চিকিৎসক এবং লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, “এই ধরনের খাবার খেতে যাঁরা দীর্ঘকাল অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, তাঁদের পেটের বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের খাবার থেকে সব সময়ে বিষক্রিয়া ও ডায়েরিয়ার ঝুঁকি থাকে।”
অথচ শহরের ফুটপাথ জুড়ে দিনের পর দিন চলছে এই বিপজ্জনক খাবারের রমরমা পসরা। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিপদ রোধে কলকাতা পুরসভার একটা বিভাগ রয়েছে। রয়েছে আইন। আছে শাস্তির বিধানও। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরে খাদ্যে ভেজাল রোধে ১৯৫৪ সালের একটা আইন ছিল। ২০০৬ সালে বাম বোর্ড ক্ষমতায় থাকাকালীন খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন হয়। ২০১১ সালে চালু হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ফুড সেফ্টি এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট চালু হয়। এই আইন অনুযায়ী শহরে বিক্রি হওয়া খাদ্যের মান নির্ণয়ের জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরির প্রয়োজন। পুরসভার ল্যাবরেটরি থাকলেও তার যন্ত্রসামগ্রী উন্নত নয় বলে পুরসভা সূত্রেই খবর।
পুরসভার তথ্য বলছে, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে হলে শহর জুড়ে ৭০০ জন ফুড সেফ্টি অফিসারের প্রয়োজন। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই জায়গায় রয়েছেন মাত্র ২২ জন। খাদ্যের মান যাচাইয়ের জন্য যে ল্যাবরেটরি রয়েছে, তাতেও চলছে কর্মী-সঙ্কট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক আধিকারিক বললেন, “শহরের ফুটপাথে বিক্রি হওয়া খাবারের মান সঠিক ভাবে যাচাই করতে হলে পুরসভাকে প্রতি বছর খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ বিভাগেই কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। এত পরিমাণ টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা আমাদের নেই।”
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ বিভাগের মেয়র পারিষদ পার্থপ্রতিম হাজারি বলেন, “আধুনিক ফুড ল্যাবরেটরি নির্মাণের জন্য জায়গা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। পরিকাঠামোগত অভাব থাকলেও ২০১৩ সালে আমরা মোট ৬২টি খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করেছিলাম যার মধ্যে ১৮টি নমুনা ত্রুটিপূর্ণ।”
ত্রুটিপূর্ণ নমুনা যাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? উত্তরে পার্থবাবু বলেন, “সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী যা ব্যবস্থা নেওয়ার, তা-ই নেওয়া হয়েছে।”
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য