কোনিয়াড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক মাত্র ডাক্তার ছুটিতে, পরিষেবায় একা নার্স

বছর তেরোর মেয়েটির জ্বর। তাকে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন মা রেখা সাঁতরা। মেয়ের শ্বাসের সমস্যা। তাঁর নিজেরও ঘাড়ে ব্যথা। কিন্তু দেখবে কে? বেলা তখন ১১টা। এমনিতে এই সময়ে ভিড়ে ঠাসা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যস্ত হয়ে থাকার কথা ডাক্তারবাবুর।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বাগদা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪৮
Share:

বাঁ দিকে, সকাল ১০টায় বন্ধ আউটডোর। ডান দিকে, বেলা ১১টা। রোগী দেখছেন নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

বছর তেরোর মেয়েটির জ্বর। তাকে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন মা রেখা সাঁতরা। মেয়ের শ্বাসের সমস্যা। তাঁর নিজেরও ঘাড়ে ব্যথা।

Advertisement

কিন্তু দেখবে কে?

বেলা তখন ১১টা। এমনিতে এই সময়ে ভিড়ে ঠাসা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যস্ত হয়ে থাকার কথা ডাক্তারবাবুর। কিন্তু বাগদার কোনিয়াড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার তথা এক মাত্র চিকিৎসক অচ্যুত মেনন রায় নিজেই অসুস্থ হয়ে ২৫ জুলাই থেকে ছুটিতে। বহির্বিভাগ খুলছে না।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি এমনিতেই পরিকাঠামোর অভাবে ধোঁকে। কোনিয়াড়া ১ ও ২ পঞ্চায়েতের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় তার রোগ যেন আরও জেঁকে বসেছে।

সকাল ১০টা নাগাদ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছেই চোখে পড়ল, বর্হিবিভাগের ঘর বন্ধ। ফার্মাসিস্টের ঘরে বসে রোগী দেখছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক মাত্র নার্স রিক্তা হালদার। তাঁকে সাহায্য করছেন স্বাস্থ্যকর্মী নেপাল মালাকার। অন্য ঘরগুলিরও বেশির ভাগেই তালা। ফার্মাসিস্টও কি নেই? তিনি গেলেন কোথায়? জবাব মিলল, খাতায়-কলমে যিনি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট, তিনি আসলে ডিউটি করেন বাগদা হাসপাতালে। কাজেই...

জ্বর নিয়ে সাতসকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন স্থানীয় বেয়ারা গ্রামের সুজিত চক্রবর্তী। এসে নার্সের কাছে শোনেন, ডাক্তার ছুটিতে। ফেরার সময়ে বিরক্তি লুকোতে পারলেন না ‘‘এক জন ডাক্তারবাবু অসুস্থ হতেই পারেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে অন্য চিকিৎসক আসবেন না!’’

চিকিৎসক যখন থাকেন, তখনই বা কেমন চলে সব কিছু?

নার্স রিক্তাদেবীর দাবি, ছুটিতে যাওয়ার আগে সপ্তাহে ছ’দিনই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত রোগী দেখতেন চিকিৎসক। শুধু যে দিন বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে তাঁর ডিডটি থাকত, সে দিন আসতে পারতেন না। এলাকার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই অবশ্য বলছেন, ডাক্তারবাবু সপ্তাহে তিন-চার দিনের বেশি রোগী দেখতেন না। অসিত সাঁতরা নামে এক স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, “এখন তো নয় ডাক্তার ছুটিতে। অন্য সময়েও সপ্তাহে দু’তিন দিনের বেশি বহির্বিভাগে চিকিৎসক পাওয়া যায় না।”

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, অচ্যুতবাবু ছুটি নেওয়ার পরে বাগদার বিএমওএইচ সুরজ সিংহ কোনিয়াড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সপ্তাহে দু’দিন করে রোগী দেখতেন। কিন্তু সম্প্রতি আর্থিক দুর্নীতি ও চিকিৎসার গাফিলতিতে রোগীমৃত্যুর অভিযোগ ওঠায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয়কুমার আচার্য আশ্বাস দেন, “এই সপ্তাহের মধ্যেই এক চিকিৎসককে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হবে।” তবে তাঁর দাবি, “জেলায় নতুন করে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করা না হলে অবশ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”

চিহ্ন তো এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সর্বাঙ্গে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য যে চারটি আবাসন রয়েছে, সবগুলিই দীর্ঘ অব্যবহারে জীর্ণ। ভেঙে গিয়েছে দরজা-জানলা। দেওয়ালে আগাছা। সাপখোপ-বিছের স্বাভাবিক আস্তানা। দুপুরে দেওয়ালে ঘুঁটে দিতেও দেখা গেল এক মহিলাকে।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দশাও তথৈবচ। কর্মীরা জানালেন, একটু বৃষ্টি হলেই দেওয়াল বেয়ে জল নামে। মেঝে ভেসে যায়। দেওয়ালে ছ্যাতলা পড়ে গিয়েছে। গোটা চত্বরে অবাধে চরে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল। আগে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। সর্বক্ষণ চিকিৎসক-নার্সেরা থাকতেন। সে সব এখন বন্ধ। সাধারণ চিকিৎসা পরিষেবাটুকু পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বাসিন্দারা জানান, সব থেকে অসুবিধা হয় রাতে। তখন রোগী নিয়ে ১৮ কিলোমিটার দূরে বনগাঁ বা বাগদা হাসপাতালে ছুটতে হয়। কবে রাজ্য আরও ডাক্তার-নার্স পাঠায়, আপাতত তারই পথ চেয়ে কোনিয়াড়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন