Hilsa

A Hilsa Story: ইলিশ কাহন: রাজ্য বিশেষে নাম বদলেছে ইলিশের, তবে বদলায়নি আবেগ - পর্ব ১

ইলিশ কি শুধুমাত্র বাংলাতেই খাওয়া হয়? এমন তো নয়... অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, গুজরাত সব জায়গাতেই এটি খাওয়া হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় এর বিভিন্ন নাম।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২২ ০৯:২৭
Share:

ইলিশ নাকি রূপোলি শস্য!

বর্ষায় কালিদাসের গন্ধর্বের মন যে পানেই ছুটুক না কেন, বাঙালির মন এবং দৃষ্টি একবগ্গা। বাজারে ইলিশ দেখলে তার সেরাটিকে থলিস্থিত করার যে আদিম আনন্দ আমাদের মজ্জায় মজ্জায়, তাকে অস্বীকার করা হয়তো সম্ভব নয়। হালকা বৃষ্টিতে একহাতে ছাতা , একহাতে বাজারের থলি, আরেক হাতে সিগারেট - বাঙালি গৃহস্থ পুরুষের এরূপ কিন্তু বাড়ির গৃহিণীরাও বেশ পছন্দ করেন – এ কথা হলপ করে বলা যায়। যদিও সামান্য ঝাঁঝিয়ে বলেন যে “আবার ইলিশ, এই বাপু খাই খাই করেই তোমরা গেলে”- কিন্তু ঠোঁটের কোণে এক মধুর হাসির ঝলকানি আমাদের আজও কেমন জানি ইয়ে ইয়ে করে তোলে। এবার নিজের হাফ কিডনি বেঁচে বা ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে কেনা সেই ইলিশ নিয়ে কি পাকানো যায়, সেটি যতক্ষণে ওস্তাদরা ভাবছেন, আসুন, বর্ষার সকালে চায়ের কাপে হালকা চুমুক দিয়ে আমরা বর্ষার রাণীর গপ্পো শুনি।

Advertisement

ইলিশ এমনই একটা জিনিস যেটাকে শুধুমাত্র এখন মাছ বলে গণ্য করলে কিন্তু ভুল করব। বাঙালির ক্ষেত্রে, সেটা এপার বাংলাই হোক আর ওপার বাংলাই হোক; ইলিশ ক্রমশ এক কামনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। মাছ নিয়ে এরকম পাগলামো কিন্তু আমাদের এতগুলি মাছের ভ্যারাইটির মধ্যে অন্য কিছুতে খুব একটা দেখতে পাই না। তাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে, তাকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তাকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কবি সত্যেন দত্তও তাকে নিয়ে গোটা একটি কবিতা লিখে ফেলেছেন -

Advertisement

ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি

ইলিশ মাছের ডিম|

ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি

দিনের বেলায় হিম|

কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,

পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,

মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে

আলতা-পাটি শিম্|

ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,

রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্|

হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়

ইলশে গুঁড়ির নাচ,

ইলশে গুঁড়ির নাচন্ দেখে

নাচছে ইলিশ মাছ|

কেউ বা নাচে জলের তলায়

ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,

নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,

পুকুরে ছিপ গাছ|

উলসে ওঠে মনটা, দেখে

ইলশে গুঁড়ির নাচ

কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে যে, ইলিশ কি শুধুমাত্র বাংলাতেই খাওয়া হয়? এমন তো নয়... অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, গুজরাট সব জায়গাতেই এটি খাওয়া হয় এবং দিকে দিকে, যুগে যুগে বললে ভুল হবে... এর বিভিন্ন নাম। অন্ধ্রপ্রদেশে এর নাম হচ্ছে ‘পুলাসা’। তেমনি মিষ্টি মধুর গুজরাটে এর নাম হচ্ছে আবার ‘পালভা’। স্ত্রী ইলিশকে এখানে বলা হয় ‘মোদেন’ এবং পুরুষ জাতির নামটি ছোট, যা বলেছিলাম, ‘পালভা’। অন্ধ্রপ্রদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘Pustelu Ammi ayina pulasa tinocchu’। শব্দটির মানে হচ্ছে, ‘ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্যে যে কোনও কিছুকেই বন্ধক রাখা যায়, এমনকি নিজের বিবাহ বন্ধক দিয়েও ইলিশ মাছটি খাওয়া উচিত’।

ইলিশ মাছের দাম কিন্তু নিতান্ত কম নয়। কারণ, একটা হতে পারে, সহজলভ্যতার অভাব। বড় ইলিশ বছরে চার থেকে পাঁচ মাস পাওয়া যায় - জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। অন্য সময় যেগুলিকে পাওয়া যায় সেগুলির ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা - প্রধানত ছোট ইলিশ খাওয়া উচিত নয় আর দ্বিতীয় কথা ছোট ইলিশ খেতে গেলে ছোট ইলিশ বড় হতে পারবে না বা ইলিশের প্রজননের সময় সেটা একটা মহান সমস্যা। কিন্তু পেটুক বাঙালি বা পেটুক ভারতীয় যেভাবে ইলিশ মাছ খাওয়া পছন্দ করে সেই ক্ষেত্রে কিন্তু সময়টা কখনই তারা মেনে চলতে পারেনি। আমাদের পক্ষে এই সময় মেনে চলা ব্যাপারটা এমনিতেই খুব একটা ধাতে নেই, আর ইলিশের ক্ষেত্রে তো একদমই নেই।

যাকগে, তামিলনাড়ুতে ইলিশ মাছের নাম কিন্তু অন্য, তাকে বলা হয় ‘উল্লাম মীন’। সিন্ধ্রি খাবার-দাবারের জগতে আবার ইলিশকে বলা হয় ‘পাল্লো মাচ্ছি’। সিন্ধ্রি খাবারে ইলিশ মাছকে কিন্তু মহা তরিবৎ সহযোগে খাওয়া হয়। তাকে ছাঁকা তেলে ভেজে খাওয়া হয়। লোকাল মশলা মাখিয়ে হালকা করে শ্যালো ফ্রাইও করা হয়। এমনকি বারবিকিউ করারও উদাহরণ আছে। ইলিশ মাছের ডিম সিন্ধ্রি খাবারে আবার এক অতি প্রচলিত খাবার। তাকে বলা হয় ‘আনি’। আমরা যেরকম ভাবে খাই, ইলিশ মাছের ডিম ভাজা; সিন্ধ্রি খাবারেও একদম সেরকম ভাবেই খাওয়া হয়।

ইলিশ মাছ বছরে চার মাস থাকতেই পারে। কিন্তু ব্রিটিশরা অনেক কিছুর মতোই এই ইলিশটাকেও বেশ বহুদিন জিইয়ে জিইয়ে খাবার এক ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল। কাঁটা চামচ দিয়ে এই কাঁটা শুদ্ধু ইলিশ মাছ খাওয়া ব্রিটিশদের খুব একটা পছন্দ ছিল না আর তাঁদের হাত বা আঙ্গুল তখনও অতটা দক্ষ হয়ে ওঠেনি যে ইলিশ মাছ শুধুমাত্র আঙুলে কাঁটা ছাড়িয়ে ফেলবে। জিহ্বার ব্যবহারে ইলিশের কাঁটা ছাড়ানো তো দূর হস্ত। সেই জন্য তাঁরা কী করেছিলেন, ইলিশ মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে একটা অদ্ভুত ডিশ বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাকে বলা হতো, ‘তেঁতুল দিয়ে ইলিশ মাছের টক’ বা ‘তেঁতুল দিয়ে আচারি ইলিশ’, যার টেকনিক্যালি নাম হচ্ছে ‘ট্যামারিন্ড পিকল্ড হিলসা’। যাতে এই ইলিশ মাছকে এই চার মাসের পরেও বহুদিন বাঁচিয়ে রাখা হতো। দুর্জনেরা যদিও বলে থাকেন যে, সুন্দরী মহিলার মুখের মুখঝামটা এবং ইলিশের কাঁটা এই দু’টি জিনিস না থাকলে পৃথিবী মোটেই ভাল হবে না, আমাদের চেনাশোনা অনেক লোক কিন্তু এর বিরোধিতা করতে পারেন এবং তাদের মধ্যে ‘বোনলেস স্মোকড হিলসা’ পৃথিবীর এক অভূতপূর্ব জিনিস, যেটিকে না খেলে জীবন বৃথা। এই বোনলেস স্মোকড হিলসাটি কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবে তৈরি নাকি বাংলাদেশের ঢাকা ক্লাবে তৈরি, তা নিয়ে এক বিশাল ঝামেলা আছে। সেই ঝামেলায় না গিয়ে আমরা এটুকু ধরে নিতেই পারি যে তখনকার শিক্ষিত মগ রাধুনীরা দুই বাংলার মধ্যে জগৎ বিখ্যাত ছিলেন। তাঁরাই এই ডিশটি আবিষ্কার করে ফেলেন। হালে শহর কলকাতার কিছু রেস্তরাঁয় , এমনকি গঙ্গাবক্ষে ভাসতে ভাসতে তারকাখচিত হোটেলে কাঁটাছাড়া ইলিশ খেলাম। বেশ লাগলো চিজ দিয়ে কাঁটাবিহীন ইলিশ।

ইলিশ, থুড়ি জীবন কণ্টকবিহীন হবে কি হবে না, সেই আদি ঝামেলা যদি বাদও দিই , ঘটি বাঙালির ভাব ভালবাসা মেনে নিলেও, দেশবিশেষে কিন্তু ইলিশ খাওয়ার ধরন পুরো আলাদা। তবে তা পরের পর্বে।

এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং ‘আষাঢ়ের গল্প’ ফিচারের একটি অংশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন