কল্পনাশ্রিত: ‘মাস্টারপিসেস’ প্রদর্শনীর কাজ। আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে
সম্প্রতি ‘মাস্টারপিসেস ২০১৮’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল আকৃতি আর্ট গ্যালারি। ভারতের শিল্পকলা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার যে সব স্বনামধন্য শিল্পী-ভাস্কর বহন করে চলেছেন, তাঁদের সমকালীন কাজই শুধু নয়, উনিশ শতকের চিরস্মরণীয় শিল্পীদের সঙ্গে অতি সাম্প্রতিক শিল্পী-ভাস্করদের কাজও আকৃতি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
২০০৭ সালে করা যোগেন চৌধুরীর দেওয়াল জোড়া এক বিরাট ক্যানভাস। প্রায় উপুড় হওয়া নগ্ন মানব। সাদা পটভূমিতে কালো রেখার কবিতাই যেন! মাথার উপর দশ আঙুলের অবস্থান বাঁ প্রান্তের পশ্চাদ্দেশ ও পায়ের মধ্যে অদ্ভুত ভারসাম্য রক্ষা করছে। পাঁজরের সাদা ড্রয়িং বার করে আনা হালকা ছায়াতপ থেকে শুরু করে পটভূমির অতি অস্পষ্ট আবছা রঙের টানটোন। স্থূল শরীরে আপাত-হালকা টোনের ব্যবহার দেখার মতো। মিশ্র মাধ্যমে যোগেনের পটজোড়া ও বিস্ময়কর অন্য কম্পোজ়িশনটি ওঁর বিখ্যাত কাজ। পড়ে থাকা বিধ্বস্ত মানবীর নগ্নতাকে যেন এক বকের মাথা ও আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে জিভ বার করা এক বাঘ উপভোগ করছে। মাত্র
দু’-একটি বর্ণের মিশ্রিত টোন ও কালো রেখার বর্ডারলাইন। সমগ্র রচনার ঘটনাবিন্যাস আধুনিক এই চিত্রশিল্পে লালসা ও যৌনতাকে কী অদ্ভুত ভাবে চিহ্নিত করছে! এখানে ছবির রচনায় ছন্দকে মনে রেখে গঠনের জ্যামিতিও তৈরি করেছেন সচেতন ভাবেই।
১৯৪৬ সালে আঁকা খুব লম্বা কাগজে পেনসিলের কাজটি নন্দলাল বসুর অন্যতম কীর্তি। নরনারীর দণ্ডায়মান মুহূর্তটি কথোপকথনের প্রাণবন্ত রূপ। পেনসিলের ড্রয়িং ও সীমিত স্ট্রোক কাজটিকে অনন্য করেছে। নির্জন পথের পাশে পাথরের উপরে বারো-তেরো জন সৈন্য সারি দিয়ে সাজানো, ঠিক যেন ভাস্কর্য। একেবারে সামনের পাথরে এক গাধা, পাশে অর্ধদৃশ্যমান পতাকা আর অনেক পিছনে ধূসর বাড়িঘর। মোটা তেলরঙে ইমপ্যাস্টো টেকনিকে করা ব্রাশিং। কী অসাধারণ পেন্টিং বিকাশ ভট্টাচার্যের! ওঁর অন্যটি কালি-তুলির চমৎকার কাজ।
কাগজের উপরে অ্যাক্রিলিকে ক’টি বিমূর্ত ল্যান্ডস্কেপ ছিল রামকুমার মান্নার। প্রতীকের মতো ফর্মগুলিকে নির্দিষ্ট পরিসরে ছড়িয়ে নিসর্গের গভীরতাকে ধরেছেন। আলো-আঁধারের বৈপরীত্য অসাধারণ! তেলরঙে করা কাজও ছিল ক্যানভাসের উপরে।
’৭০ সালের তেলরঙের এক কাজ ছিল রাজার— প্রায় বিমূর্ত। ২০০৫-এ এসে অ্যাক্রিলিকে কাগজে আঁকলেন লাল-নীলের সুস্থিত সহাবস্থানে আরও বিমূর্ত ও দৃষ্টিনন্দন একটি ছবি। আরা-র সাদাকালো মনোক্রোমের নগ্ন শরীরে হাঁটু মুড়ে নৃত্যরত ছন্দের অপূর্ব অভিব্যক্তি। প্রায়ান্ধকার এক পটভূমিতে এর লাবণ্যময় ড্রয়িং এবং আলো বার করে আনা ছায়াতপ দেখার মতো। কোলে কুকুরশাবক নিয়ে পরিতোষ সেনের আত্মপ্রতিকৃতি করা হয়েছে মাউন্টবোর্ডে—জলরঙে স্টাইলাইজ়েশনের এক অনন্য নিদর্শন! অমৃতা শেরগিলের চারকোলে কাগজে আঁকা নগ্নিকার পশ্চাদপট। যামিনী রায়ের ছোট রঙিন বোর্ডে টেম্পারার নিসর্গ বহু পুরনো কাজ। সদানন্দ বাবরের তেলরঙের বিমূর্ত নিসর্গ। শক্তি বর্মণের তেলরঙে ওঁর গ্র্যাফিক্স প্রিন্টের হুবহু স্টাইল— আয়নায় দু’টি মুখের প্রতিচ্ছবি, পিছনে ভেঁপু হাতে অন্য জন, সামনে বিরাট পায়রা। পিকাসোর গভীর ছাপ এই ছবিতে।
মনু পারেখের ‘ল্যান্ডস্কেপ উইথ মিডনাইট টু’-এ খুব উজ্জ্বল আকাশের চাঁদ ও তার রঙিন আলোর বিচ্ছুরণ চোখ আটকে রাখে। গণেশ হালুইয়ের বিমূর্ত ব্রোঞ্জ এবং সতীশ গুজরালের পাখি হাতে বসে থাকা পুরুষ ব্রোঞ্জের নান্দনিক সৃষ্টি! গণেশ পাইনের ‘হেড অফ আ উয়োম্যান’ নামে কাগজে ও কন্টিতে করা কাজটি সাধারণ মানের। পাইনীয় কোনও মেজাজই এতে নেই। হুসেনের ‘রাজস্থানী হেড’ও তেমনই একটি কাজ। কবর অতিক্রম করা কালো ঘোড়ার একটি মুহূর্ত জলরঙে চমৎকার ধরেছেন শ্যামল দত্তরায়। সন্তানকে পাশে রেখে বিশাল বই হাতে বেঞ্চে বসে পাঠরত মানুষটি অসীম বসুর তৈরি ব্রোঞ্জের অনবদ্য কাজ। যেমন বিমল কুণ্ডুর ‘হেড’— সবুজ পাতিনায় আশ্চর্য জ্যামিতি এক বিশিষ্ট আবেদনে ভরিয়েছে মুখটিকে।
এ ছাড়াও আকবর পদমসী, সুনীলমাধব সেন, রবীন মণ্ডল, হিম্মত শ, লক্ষ্মা গৌড়, লালুপ্রসাদ সাউ, অখিলচন্দ্র দাস, বিপিন গোস্বামী, কৃষেন খন্না প্রমুখের উল্লেখযোগ্য চিত্র-ভাস্কর্য ছিল এই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ।