উজ্জীবিত: ‘সোজার্নস উইথ টেম্পারা’র কাজ। সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে
তাঁর সরল দর্শনের মধ্যেও নিজস্ব চেতনার রূপান্তর ঘটত। তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণে পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ জীবনদর্শনের অন্তর্নিহিত নীরব ও কৌতূহলোদ্দীপক সন্ধান চলত নিরন্তর। এই অভিজ্ঞতার আত্মোপলব্ধির ফসল ফলানোর জন্য জমি তৈরি থেকে রং-রেখার সমন্বয়ে যে চাষ-আবাদ, টেম্পারা গোয়াশের বহু বিস্তৃত সতেজ ফলনই চিনিয়ে দেয় তার সফল অধ্যায়টি।
তিনি গৌতম বসু। ২০১৭-য় ৬৮ বছরের অকস্মাৎ প্রয়াণ। অবিরত শিল্পচর্চার মগ্নতায় নখর বসানো মৃত্যু টেম্পারার নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার জানালাগুলি বন্ধ করে দিল গৌতমের জীবনে।
‘সোজার্নস উইথ টেম্পারা’ নামে তাঁর বিরাট মাপের পূর্বাপর প্রদর্শনীটি শেষ হল অ্যাকাডেমিতে মোট ৬৪টি কাজ নিয়ে। অবয়বধর্মী ছবি থেকে অধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ, পুরাণকল্প, ঘরবাড়ির অভ্যন্তর, বিশেষত নিজস্ব বাগান, টব, গাছ, ফুল-লতাপাতা, স্মৃতির পূর্বপুরুষ, নিসর্গ, দেবদেবী, ফোটোগ্রাফিচর্চার ফলে তোলা ছবির টুকরো ছিন্ন অংশে সাজানো কোলাজ সমেত এই সাজানো বাগান হঠাৎ শুকিয়ে গেল।
গৌতমের রেখানির্ভর টেম্পারায় ছবির সমগ্র অংশ জুড়ে থাকা এক মায়াজাল— যা তুলির অজস্র আঁচড়ে তৈরি টেক্সচারের অনন্য সূক্ষ্মতা। কখনও আলোকিত দৃশ্যপট থেকে অন্ধকারের দিকে তার যাত্রা। ছবিতে উজ্জ্বলতার প্রাবল্যকে প্রশ্রয় দেননি গৌতম। স্বভাবের মতোই ওঁর বর্ণও যেন বড় নিয়ন্ত্রিত, চাপা। কোথাও যেন বিষাদের সুরের মধ্যেও বেজে ওঠা এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রফুল্লতা। তাও বড্ড নৈঃশব্দ্যের কথাই জানায়। শুকনো রং— খয়েরি, লালচে খয়েরি, বাদামি। ভিন্ন ছায়াতপের হলুদ-সবুজ অন্ধকার। আলোকিত হয়েও উদ্দাম নয়। নিরীহ রেখার কাব্যিক টানটোন ও গতিবিধি। এমনই এক একটি মায়াবি উপস্থাপনায় গৌতমের ছবির যাবতীয় ধারাবাহিকতা যেন জীবনদর্শনের এক গভীর আখ্যানকেই উপস্থাপিত করে। এমনকি কখন যেন মনে পড়িয়ে দেন বেন নিকলসনকেও।
সামগ্রিক ভাবে তাঁর চিত্র পর্যবেক্ষণ করলে আধ্যাত্মিকতার তীব্রতা চোখে পড়ে না। যদিও তন্ত্র নিয়ে করা ওঁর কাজ কিংবা পুরাণকল্পনা ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও গৌতমের ছবি জীবনের ছবি, সাধারণ মানুষের ছবি— আধুনিকতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে কোনও শৌখিন প্রয়াস নয়! তাঁর এই সুবিন্যস্ত যাত্রাপথে শিল্পশিক্ষার প্রথম পাঠ নেওয়া অজিত গুপ্ত থেকে অতুল বসু হয়ে পরবর্তী ভারতশিল্পের অভ্যন্তরীণ পাঠান্তর পর্বের মধ্য দিয়ে এগিয়েছিল। অজিত গুপ্তের কাছে শেখেন টেম্পারা।
কাগজের উপরে বা বোর্ডে কাপড় সেঁটে জমি তৈরি করে নিয়ে পরতে পরতে বর্ণ চাপানো, ধোয়ামোছার বিবিধ করণকৌশলের মধ্যে তুলির সূক্ষ্ম স্ট্রোকের অজস্র-অর্বুদ টেক্সচার ছবিকে এক পরিমিত অলঙ্কার-ভূষণে সজ্জিত করেছে—যা কিনা একই সঙ্গে চোখের আরাম ও আত্মার শান্তি।
রেখার টুকরো অংশ তৈরি করে প্রতিকৃতিতে অথবা অন্যত্র সুবিন্যস্ত করেছেন রূপবন্ধকে। নানা আকারকে ভেঙেছেন আধুনিক দৃশ্যকল্পের টানে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি রিয়্যালিজ়ম। পটভূমিতে সরলরেখার ছোট-বড় জ্যামিতি তৈরি করেছেন, এসেছে প্রতিচ্ছায়াবাদের ধরনের সঙ্গে অভিব্যক্তিবাদের চেতনা ও ঘনকবাদী বিশ্লেষণ। তবু কোনওটাই চড়া সুরের গিটার নয়— সরোদের নিরীহ আলাপ! আলঙ্কারিক প্যাটার্নকে রক্ষা করেও বর্ণের ছায়াতপের অন্ধকারে ধূসরতা মিশিয়েছেন ‘হরগৌরী’তে। চেয়ারে বসা রহস্যময় মানুষের ড্রয়িং ‘ফ্রিডম উইদিন দি ওয়েব’ অসামান্য কাজ। ‘মাই গার্ডেন ইলেভেন’, ‘লিভিং ওয়াল ওয়ান’ ইত্যাদি কাজগুলোয় নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন টেম্পারায়। স্টাইলাইজ়েশন, টেকনিক ও কম্পোজ়িশনের নিয়ত যে চর্চা ও সৃষ্টি এর মধ্যে— যে ভাবে বর্ণ বিলেপন করে ঘষে তুলে ফের বর্ণের আস্তরণ তৈরি করা, আশ্চর্য কতশত ছায়াতপের গভীরতা আনা, তুলির কী সূক্ষ্ম স্ট্রোকে চিত্ররহস্যের সৌন্দর্যকে পাল্টে দেওয়া— যার অন্তর্নিহিত ক্ষীণ অস্বচ্ছতা থেকে উঠে আসা এক নরম অনুজ্জ্বলতা যেমন ক্রমাগতই মন খারাপ করায়, ঠিক তেমনই মনকে চালিত করার এক আলোর দিশাও দেখায়।
ছবিতে গৌতম জ্যামিতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সমতল বর্ণ ও ছায়াতপের মোহময় বন্ধনে, রেখার ঘেরাটোপে। সমস্ত অন্তর্লীন সত্যকে গহন আশ্রয় থেকে সযত্ন নির্বাচনে তুলে এনে সাজিয়েছেন ওঁর সমগ্র চিত্রকলা। বহু কাল মনে থাকবে।