Art exhibition

Subhanil Roy: তাঁর চিত্রবিশ্ব নিজস্ব ভাষার এক বৈচিত্রময় নৈঃশব্দ্য

অনেক শিল্পীর কাজের কিছু প্রভাব স্বল্প হলেও তাঁর ছবিতে লক্ষ করা যায়। তবু রচনার ক্ষেত্রে একটি সংযমকে বরাবর রক্ষা করেছেন।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৪৬
Share:

স্বভাবলাজুক, অপেক্ষাকৃত মিতবাক, আপাতনিরীহ শুভনীল রায় একজন স্বশিক্ষিত চিত্রকর। সে অর্থে শিল্পকলার কোনও প্রথাগত বিদ্যে নেই। ছোট থেকেই ছবি আঁকার তীব্র বাসনাকে লালন করেছিলেন, যা এখনও ধারাবাহিক চর্চার গতিকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। পুঁথিগত বিদ্যা বলতে সাধারণ স্নাতক। পিতার অকস্মাৎ মৃত্যু তাঁকে চাকরিজীবনে ফিরিয়ে আনলেও, তাঁর শিল্পের পৃথিবী তাতে ব্যাহত হয়নি। সমকালীন শিল্পী অলোক সর্দারের অধীনে দীর্ঘকাল শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে শুভনীলের ২২টি কাগজে করা ছোট-বড় ছবির প্রথম একক প্রদর্শনীটি শেষ হল। তেলরং ছাড়া প্রায় সব মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। বিশেষ করে জলরং, পেন, চারকোল, ড্রাই প্যাস্টেল, মিশ্র মাধ্যম, পেনসিল, কন্টি ও অ্যাক্রিলিকের কাজ ছিল।

Advertisement

অনেক শিল্পীর কাজের কিছু প্রভাব স্বল্প হলেও তাঁর ছবিতে লক্ষ করা যায়। তবু রচনার ক্ষেত্রে একটি সংযমকে বরাবর রক্ষা করেছেন। বর্ণ বা রূপবন্ধ, এমনকি সামগ্রিক অ্যারেঞ্জমেন্টের ক্ষেত্রেও কোনও রচনায় বাহুল্য চোখে পড়েনি। নিজের মতো করে স্বচ্ছন্দে কাজ করেছেন, স্বভাবের মতো তাঁর ছবিও যেন নির্জন, উচ্চকিত নয়। রঙের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা চলে। রঙের তীব্র উজ্জ্বলতাকে মিশ্রবর্ণ ও সাদামেশানো রঙের ঘষামাজায় অপেক্ষাকৃত মলিন করেও একটি লাবণ্য এনেছেন। রঙের আলাদা এক প্রভা তৈরি করছে সমগ্র রচনার আলো। বিচ্ছুরিত না হয়েও যা আপাত-অনুচ্চ ভাবেই ভীষণ বাঙ্ময়। গ্রাম্য নিসর্গ তাঁকে বরাবর অনুপ্রাণিত করেছে। আধুনিক নগরসভ্যতার ঘিঞ্জি ও দূষণসর্বস্ব পরিবেশ, কোলাহল-মুখরতা, আমজনতার ভিড়ভাট্টা থেকে তাঁর ছবি শত যোজন দূরে। ছবিতে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন এক নৈঃশব্দ্যের ভাষা।

পট তাঁর কাছে একটি সমতল ক্ষেত্র, যেখানে তুলির ব্যবহার কখনও দ্রুত, কিন্তু সংযত ও শান্ত। হঠাৎ স্তিমিত, যেখানে আলোর রেখা যেন আঁধার ভেদ করে এক কাব্যিক উপমা তৈরি করছে। কখনও অতি হালকা রং, পাতলা ওয়াশের মতো, পেনসিলের ঝোড়ো রেখার স্বাচ্ছন্দ্যেও সেখানে তৈরি হচ্ছে নৈঃশব্দ্য। একটি শিশুসুলভ সারল্যময় রঙের টানটোন ও বিন্যাসও কিন্তু আশ্চর্য উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তাঁর কাজে।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের ছবির অনুষঙ্গ কোথাও যেন শুভনীলের ছবির সঙ্গে সামান্য হলেও মিলে যায়। যেমন মাতিসের ডিজ়াইন-সমৃদ্ধ কাজগুলির রেশ তাঁর ছবিতে একটু হলেও লক্ষ করা যায়। ভারতের রবীন্দ্রনাথ থেকে মনজিৎ বাওয়া, গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী, ভূপেন খক্কর, ফ্রান্সিস সুজা, আকবর পদমসির কাজ তাঁকে খুবই আপ্লুত করে।

নির্জন: শুভনীল রায়ের চিত্রকর্ম

তাঁর কাজে ইউরোপীয় বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী মার্ক রোথকোর প্রভাব সর্বাধিক। এ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন ভাবে ওসকার কোক্কাসকা, মার্ক শাগালও প্রতিভাত হন সূক্ষ্মতায়। কিন্তু জ্যাকসন পোলক, গগ্যাঁ, মদিগিলিয়ানি, ভ্যান গঘ, সেজাঁর ছবি থেকেও তিনি অনেক কিছু শিখেছেন বলে তাঁর দাবি। এখনও রেমব্রাঁর অবিস্মরণীয় সব পোর্ট্রেট অয়েল স্কেচিং পেপারে অয়েলেই কপিওয়র্ক করেন। ‘‘আমি এ ভাবে আরও কিছু শিখতে চাই,’’ শিল্পীর স্বীকারোক্তি। তাঁর পছন্দের তালিকায় থাকা ফ্রিডা কাহলো, গুস্তভ ক্লিমৎ, এডওয়ার্ড হুপাররাও আছেন। অকস্মাৎ তাঁর অজান্তেই যেন নিজের ছবির অন্তরালে রয়ে যায় তাঁদেরও কিছু রেশ, বেশ বোঝা যায়।

কোথাও নির্দিষ্ট কোনও স্টাইল বা টেকনিককে তিনি অনুসরণ করেননি, অনুকরণও নয়। বরং একটি ‘ওন ল্যাঙ্গোয়েজ’ তৈরি করেছেন রেখা ও রঙের সাহচর্যে। সাহসিকতার সঙ্গে কম্পোজ় করে রঙের ও স্পেসের মধ্যে একটি ভারসাম্য এনেছেন। ছবিতে স্পেসের ওই ব্যাপ্তি বা পরিসরের একাধিপত্যে একটি মাত্র ছোট্ট অবজেক্টও কখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। ইউরোপীয় ঘরানায় এমন বিমূর্ততা বা অভিব্যক্তিবাদী রচনায় যা দেখা গিয়েছে অনেক কাজে। এমনকি জার্মান অভিব্যক্তিবাদ, প্রতিচ্ছায়াবাদও মনে পড়ে যায়। একটি অদ্ভুত টেক্সচারও তৈরি করেছেন ছবিতে, সমতলীয় বর্ণের পাশে বা উপর-নীচে। তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য, মসৃণ সমতল বর্ণের পাশে ঘোর কালোর সঙ্গে অন্য বর্ণের বৈপরীত্য, নরম, কখনও উষ্ণ বর্ণ, অনুজ্জ্বল বর্ণের বিভা, ডিজ়াইন তৈরির প্রবণতা, কোথাও কিছুটা টেক্সটাইল কোয়ালিটি, গ্রাফিক কোয়ালিটি— সবই লক্ষণীয়।

স্কেচি খসড়ার মতো কিছু কাজ, অদ্ভুত নাটকীয়তা, উড়ন্ত মানব-মানবী... তাঁর বিমূর্ততার কাব্যময় ছবির পৃথিবীতে কখনও কখনও বেশ একটা মজাও উপলব্ধি করা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন