ঘড়ির কাঁটা সকাল ৯টা ছুঁইছুঁই। ট্রেনও ছুটছিল স্বাভাবিক ছন্দে। কেউ কেউ সফর করছেন ছুটি কাটানোর আনন্দে, কারও আবার গন্তব্য ছিল কর্মস্থল। আনন্দ-ব্যস্ততার মধ্যে সব ঠিকই ছিল। তখনও কেউ জানতেন না কিছু ক্ষণ পর প্রাণটাই আর থাকবে না!
হঠাৎই বিশাল একটা ঢেউ এসে ডুবিয়ে দেয় আস্ত রেলগাড়িকে। মুহূর্তের মধ্যে রেললাইন থেকে ছিটকে যায় ট্রেনটি। নিমেষে চারিদিক ভরে ওঠে হাহাকারের শব্দে! আশপাশে শুধুই ‘বাচাঁও, বাচাঁও’ আর্তনাদ। কেউ কেউ নিজেকে উদ্ধার করতে পারলেও প্রাণ যায় দেড় হাজারেরও বেশি যাত্রীর।
কথা হচ্ছে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের। শ্রীলঙ্কায় সে দিন ভয়াবহ সুনামি আছড়ে পড়েছিল। বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পাননি লক্ষ লক্ষ মানুষ। শ্রীলঙ্কার কলম্বোর কাছে সুনামির জেরে ভেসে গিয়েছিল আস্ত একটা ট্রেন। তাতে প্রাণ গিয়েছিল ১৭০০ মানুষের।
সাগরতট বরাবর রেললাইন দিয়ে যাচ্ছিল ট্রেনটি। গন্তব্য কলম্বো থেকে মাটারা। পেরালিয়া গ্রামের কাছে এসে ট্রেনটি সিগনালে থেমে যায়। রেললাইনের এক দিকে গ্রামবাসীদের বসবাস। অন্য দিকে শুধুই ভারত মহাসাগরের জল। এই দুইয়ের মাঝে সিগনালে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেনটি।
যাত্রীরা হঠাৎই লক্ষ করেন সাগরের জল যেন সমুদ্রতট থেকে পিছনে চলে যাচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা আছড়ে পড়ে। তাতে জল ঢুকে যায় ট্রেনে। কিন্তু ট্রেন লাইন থেকে সরে য়ায়নি।
কিন্তু রক্ষা মিলল না দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপটে। প্রথম ঢেউয়ের কিছু ক্ষণ পরই ৬০ ফুট উঁচু হয়ে আসে প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ, যার আঘাতে মুহূর্তে লাইনচ্যুত হয়ে যায় ট্রেনটি। যাত্রীরা ছিটকে পড়েন এ দিক-ও দিকে।
শোনা যায়, দৈত্যাকার ঢেউটি গাছের ভেতর দিয়ে গর্জন করে ট্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ট্রেনটিকে রেললাইন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় সেই ঢেউ। ঢেউয়ের ধাক্কায় আস্ত ট্রেন জলে ঘুরতে থাকে।
সুনামি ট্রেনটির পাশাপাশি ওই অঞ্চলের আশপাশের ঘরবাড়ি ও গাছপালাও গ্রাস করে ফেলে। এলাকার কয়েকশো মানুষ জলে ডুবে যান, তাঁদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।
ভারত মহাসাগরের সুনামির আঘাতে অর্ধেক শ্রীলঙ্কা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। রেহাই পায়নি ‘দ্য কুইন অফ দ্য সি’ নামক যাত্রিবাহী ট্রেনটিও। ট্রেনটির আসল নাম ছিল মাতারা এক্সপ্রেস। তবে সেটি বিখ্যাত ছিল ‘দ্য কুইন অফ দ্য সি’ নামেই।
তেলওয়াট্টার কাছে পেরালিয়ায় অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল রেললাইনে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রেনের আটটি বগি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭০০ যাত্রীর মৃত্যু হয়। তার মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ যাত্রীর দেহই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মাত্র হাতেগোনা কয়েক জন কোনও রকমে নিজেদের উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। দুর্ঘটনায় আটটি কামরার যাত্রীরা সম্পূর্ণ ডুবে যান। তাঁরা দরজা পর্যন্ত খুলতে পারেননি। ফলে অধিকাংশ মানুষই নিখোঁজ হন এবং প্রাণ হারান।
ট্রেনটির ইঞ্জিনের নম্বর ছিল #৫৯১। ইঞ্জিনের নাম ছিল ম্যানিটোবা। ঢেউয়ের ধাক্কায় ইঞ্জিনটি ছিটকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে একটি জলাভূমিতে গিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ইঞ্জিনচালক ও সহকারী চালকের।
প্রাথমিক তদন্তে জানানো হয়, ট্রেনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১৫০ জন বেঁচে রয়েছেন। পেরালিয়া গ্রামেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ৫০০ গ্রামবাসী মারা যান, অনেকে নিখোঁজ হন।
সে দিন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ওই ভুমিকম্পের জেরেই ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টি হয়, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শ্রীলঙ্কার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
সুনামিতে শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৪০ হাজার জন মারা যান। ৩০ হাজারের কাছে মানুষকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। হাজার হাজার বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, দোকান, রাস্তা ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই একই সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়াও। ছোট ট্রেন এবং মালবাহী রেলগাড়ির দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের প্রাণ গিয়েছিল।
সুনামির জেরে আরও অনেক রেল দুর্ঘটনা হয়। ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানে সুনামি হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯। তাতে বেশ কিছু স্থানীয় ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদিও প্রাণহানি হয়নি।
শ্রীলঙ্কার ওই দুর্ঘটনাস্থলের কাছে আজও সংরক্ষিত রয়েছে ট্রেনের কিছু অংশ। এটিই প্রথম কোনও ট্রেন দুর্ঘটনা যা সুনামির জন্য ঘটেছিল। পৃথিবীর মানুষ বহু রেল দুর্ঘটনার সাক্ষী। তবুও এই দুর্ঘটনার কথা মনে করলে আজও শিউরে ওঠেন অনেকে।