চাকরি করতে হলে দিনে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে তার বেশি সময়ও দিতে হবে অফিসকে। তা হলেই মিলবে সাফল্য! এমনই পন্থায় বিশ্বাসী ২৩ বছরের দক্ষ গুপ্ত। নিজের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ‘স্টার্টআপ’-এ এই সূত্রেই চাকরি দিচ্ছেন তিনি।
দক্ষ গুপ্ত, ২৩ বছর বয়স। সদ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোয় এক স্টার্টআপ সংস্থা খুলেছেন। সংস্থা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই তরুণ। সেখানে কাজ করতে হলে কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে, নচেৎ কোনও জায়গা নেই।
এমন মন্তব্যের পর বিতর্কের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে চরম, অমানবিক বলে মনে করছেন। যদিও বিকল্প রয়েছে। দক্ষ তাঁর সমাজমাধ্যমে এক বার দাবি করেছিলেন, বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এমন মানুষ আছেন যাঁরা এই কঠোর কাজের পরিবেশই চাইছেন।
দক্ষের পড়াশোনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি জর্জিয়া টেক থেকে স্নাতক স্তর পড়েছেন। ছোট থেকে কম্পিউটারে ঝোঁক ছিল। পড়াশোনাও করেছেন সেই বিষয় নিয়ে। কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে স্নাতক তিনি।
নিজের সংস্থা প্রতিষ্ঠার আগে বেশ কিছু সংস্থায় চাকরি করেছেন দক্ষ। স্নাতকের পর প্রথমে কোয়ালকমে কাজে যোগ দেন। সেখান থেকে অ্যামাজ়ন ওয়েব সার্ভিসেসে শিক্ষানবিশ ছিলেন। তার পর চাকরি ছেড়ে নিজের সংস্থা প্রতিষ্ঠার কাজে মন দিয়েছিলেন এই উদ্যোক্তা।
২০২৩ সালে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে কাজ করতে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন গ্রেপটাইল। খুবই অল্প কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই সংস্থা। তাতে কী হয়েছে! কিছু দিনের মধ্যেই দক্ষের এই সংস্থা ৫৩ লক্ষ ডলার ‘সিড ফান্ডিং’ সংগ্রহ করে ফেলে। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের থেকে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা জোগাড় করে ফেলেন তিনি।
দক্ষের দাবি, খুব অল্প সময়ে এমন সাফল্যের কারণ ৯-৯-৬ ফর্মুলা। কঠোর পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। তাঁর মতে ঘড়ি দেখে নয়, বরং কাজের নিরিখে পরিশ্রম করতে হবে। এমন মন্তব্যকে অনেকেই ২০২৩ সালে ইনফোসিস কর্তা নারায়ণ মূর্তির বক্তব্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সে সময় নারায়ণ মূর্তি সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজের পক্ষে সওয়াল করে বলেছিলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপানের মানুষেরা দেশের উন্নতি করতে অতিরিক্ত সময় কাজ করেছিলেন। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তরুণ প্রজন্মের আরও কঠিন পরিশ্রম করা উচিত।” যদিও পরবর্তী কালে বিতর্ক এড়াতে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটেছিলেন ইনফোসিস কর্তা।
দক্ষের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে আক্রমণ করেছিলেন অনেকেই। তাঁদের কথায় এমন পন্থা বিষাক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করছে এবং এটি একটি ভয়ঙ্কর মানসিকতার প্রকাশ। কেউ কেউ অন্য কথাও বলেন। তাঁদের মতে, এত পরিশ্রমের পর যদি ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া না যায়, তা হলে সে চাকরি করা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
যদিও শোনা যায়, গ্রেপটাইলে কনিষ্ঠ কর্মচারীর বার্ষিক বেতন কোটি টাকার কাছাকাছি। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সংস্থায় জুনিয়র কর্মীদের বছরে প্রায় ১,৪০,০০০ থেকে ১,৮০,০০০ মার্কিন ডলার শুধু মূল বেতন (বেসিক পে) পাওয়ার সুযোগ থাকে, যা ভারতীয় মুদ্রায় ১.২ থেকে ১.৫ কোটি টাকার কাছাকাছি। এখানেই শেষ নয়, এই বেতনের পাশাপাশি সংস্থার লভ্যাংশ-সহ বছরে অতিরিক্ত ১,৩০,০০০ থেকে ১,৮০,০০০ ডলার দেওয়া হয় কর্মীদের।
যে সব কর্মীর অভিজ্ঞতা সাত বছরের বেশি, তাঁদের মূল বেতন বছরে প্রায় ২,৪০,০০০ থেকে ২,৭০,০০০ মার্কিন ডলার হতে পারে। এ ছাড়াও কর্মীদের জন্য আরও সুবিধার কথাও উল্লেখ করেছেন দক্ষ। জানিয়েছেন, বিনামূল্যে দুপুর ও রাতের আহার, যাতায়াতের সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা-সহ আরও সুবিধা উপভোগ করতে পারেন তাঁর সংস্থার কর্মীরা।
তবে এই সমস্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য কর্মীদের সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতেই হবে। তা হলেই মিলবে চাকরি। দক্ষ সমাজমাধ্যমে বলেছেন, এমন কাজের ধরন চিরকাল চলবে না। কিন্তু কোনও সংস্থা যখন শুরু হচ্ছে তখন বেশি পরিশ্রম করতেই হয়। না হলে দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব নয়।
প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দক্ষকে। বাধ্য হয়ে তরুণ উদ্যোক্তা এই নিয়ে তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডলে প্রতিক্রিয়া দেন। জানান, তাঁর ইনবক্সে আসা মেসেজের মধ্যে ২০ শতাংশ ছিল মৃত্যুর হুমকি। বাকি ৮০ শতাংশই নাকি ছিল চাকরির আবেদন। তাই, সত্যি যাঁরা চাকরির সন্ধানে রয়েছেন তাঁদের সময়ের এই কঠোর বিধি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই বলেই দাবি করেন দক্ষ।
নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময়ই সংস্থার তরফে কাজের ধরন উল্লেখ করে দেওয়া হয়। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই পরিশ্রমের ধারণা দিয়ে দেওয়া হয় প্রার্থীদের, যাতে কাজে যুক্ত হওয়ার পর কারও সমস্যা না হয়।
দক্ষের কাজের এই ধরনকে অনেকে চিন-জাপানের সংস্থার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। বিশ্ব জুড়ে এমন বেশ কিছু দেশ রয়েছে যেখানে চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয় কর্মীদের। সপ্তাহে কোনও ছুটিও থাকে না অনেক সময়।
চিনের বেশ কিছু বড় সংস্থা ৯-৯-৬ পন্থা মেনে কাজ করে। অর্থাৎ সপ্তাহে ছ’দিন, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। জাপানে আগে অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে মৃত্যু বা স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকত। যদিও এর পর সরকারের তরফে নীতি প্রয়োগ করা হয়। তা সত্ত্বেও, এখনও সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়ে সে দেশে। অনেকটা একই হাল ইউরোপ, আমেরিকার বেশ কিছু শহরেও।
২০২৪ সালে গ্রেপটাইল বিপুল ব্যবসা করে। ওই বছরের নিরিখে মোট ৬ জন সদস্য ছিল সংস্থায়। দলের কর্ণধারও একই ভাবে কাজ করেন নিজের সংস্থায়। এক বছরের মধ্যে ব্যবসায় বিপুল শ্রীবৃদ্ধি শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রমের জন্যই হয়েছে বলে মত দক্ষের।