‘দ্য প্রোমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ পাশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সমস্ত অনলাইন গেমের উপর চাপল সরকারি নিষেধাজ্ঞা। টাকা দিয়ে বাজি ধরা ও জুয়া খেলার মতো অনলাইন গেমের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বুধবার দুপুরে বিল পেশ করার পর বিকেলের মধ্যেই বিলটি লোকসভায় পাশ করা হয়। বৃহস্পতিবার রাজ্যসভাতেও পাশ হয় বিলটি।
প্রযুক্তির দৌলতে দেশে অনলাইন গেমের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। গত কয়েক বছরে গেমিং শিল্পে ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বহু ছোটবড় ভুঁইফোড় সংস্থা। তাদের বিজ্ঞাপনী চটক দেখে অনেকেই অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন। আবার এই ধরনের গেমে যোগ দিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনলাইন গেমের ফাঁদে পড়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খোয়াতেও হয়েছে অংশগ্রহণকারীদের।
টাকা দিয়ে বাজি ধরা ও জুয়া খেলার মতো অনলাইন গেমের বাড়বাড়ন্তে রাশ টানতে বিপুল পরিমাণ জরিমানার প্রস্তাব রয়েছে বিলে। টাকার লেনদেনের মাধ্যমে অনলাইনে গেম খেলার ব্যবস্থা করা হলে অথবা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে গেম খেলা হলে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। তিন বছর পর্যন্ত টানতে হতে পারে জেলের ঘানিও।
এই বিল লোকসভায় পাশ হওয়ার পর থেকেই শঙ্কার মেঘ জমা হয়েছে ভারতের গেমিং শিল্পে। কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে অনলাইন গেমিং শিল্পের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের। এই বিলটি আইন হিসাবে জারি হলে চরম ক্ষতির মুখে পড়তে পারে হাজার হাজার গেমিং সংস্থা। অন্য দিকে, কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাতে পারে সরকারও। তথ্য বলছে, শুধুমাত্র এক মাসে অনলাইন গেমে বাজি ধরে খেলার জন্য ভারতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
কেন্দ্রীয় সরকার অনলাইন গেমকে নিষিদ্ধ করার ফলে সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ২ লক্ষ মানুষ রোজগার হারাবেন বলে শিল্পমহলের ধারণা। আইন কার্যকর হলে ক্ষতির মুখে পড়বে আনুমানিক ৪০০টি সংস্থা। গেমিং সংস্থাগুলির যুক্তি, এই শিল্পক্ষেত্রটি থেকে মোটা টাকা রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্র।
বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ার পর সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে তিনটি সংগঠন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের কাছে হস্তক্ষেপের আবেদনও জানিয়েছিল। গেমিং সংস্থার সংগঠনগুলির দাবি, ২ লক্ষ কোটি টাকার এই শিল্পক্ষেত্র থেকে বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা আয় হয়। তার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বাবদ সরকারি ভাঁড়ারে জমা পড়ে।
শেষ পাঁচ বছরে ভারতে অনলাইন গেম খেলা গ্রাহকের সংখ্যা ৩৬ কোটি থেকে বেড়ে একলাফে ৫০ কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে। বিদেশি লগ্নিরও ঢল নেমেছে গেমিং শিল্পে। সংগঠনের দাবি, ২৫ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে গত পাঁচ বছরে।
২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে অনলাইন গেমিংয়ের উপর ২৮ শতাংশ জিএসটি চাপিয়েছিল সরকার। নতুন আইনের কোপে গেমিং শিল্প বন্ধ হলে সরকারি কোষাগারে বছরে কর কম জমা পড়ার পরিমাণ হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক লেনদেনে যুক্ত অনলাইন গেমিং বন্ধ হলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাবে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি।
অন্য দিকে সরকারের দাবি, অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই ধোঁয়াশা ছিল। উঠছিল নানা অভিযোগও। বহু মানুষ এই সমস্ত গেমে যোগ দিয়ে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছিলেন।
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, অনলাইন গেমিংয়ে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। ভূরি ভূরি অভিযোগ জমা পড়ার পরই নড়েচড়ে বসে সরকার। এর পরই অনলাইন গেম নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। যে সব গেম মানুষের জন্য ক্ষতিকারক এবং যে সব গেমে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে সেগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা আনছে সরকার।
সরকার মনে করছে, টাকা দিয়ে খেলা অনলাইন গেমগুলি সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। তাই রাজস্ব ক্ষতির চেয়ে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র।
এই বিলে অনলাইন গেমের দু’টি নির্দিষ্ট সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করেছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, বিনোদন বা শিক্ষামূলক ই-স্পোর্টসগুলিতে কেন্দ্রীয় সহায়তা সবসময় বজায় থাকবে। সেই ধরনের গেমের আওতায় আনা হবে সুদোকু, ই-দাবা ইত্যাদিকে। এদের প্রচার ও প্রসারে সরকারি সহায়তা মিলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অশ্বিনী। এর জন্য আলাদা বাজেটও তৈরি করার কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
লোকসভায় এই বিল পাশ হওয়া ফ্যান্টাসি স্পোর্টস গেমিং সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে অশনি সঙ্কেত। এই ধরনের বেশির ভাগ গেমিং সংস্থারই দাবি, তারা বাজি ধরা, টাকা নয়ছয় করা কিংবা অবৈধ জুয়া খেলার মতো কোনও রকম ‘অবৈধ কার্যকলাপে’ জড়িত নয়।
ফ্যান্টাসি গেমিংয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি না হয়ে ঘুরপথে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। প্রথমে অল্প টাকার বিনিময়ে পরিচিত তারকা বা খেলোয়াড়দের নিয়ে তালিকা বানাতে হয়। সেই খেলোয়াড়েরা বাস্তবে কেমন ফল করলেন, তার ভিত্তিতে টাকার লেনদেন হয়।
নতুন এই বিলে ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত অনলাইন গেমের জন্য আর্থিক লেনদেন ও সেই সংক্রান্ত যে কোনও সহায়তার উপর বিধিনিষেধ জারির প্রস্তাব রয়েছে।
অনলাইন জুয়া বা বাজি রেখে গেম খেলার প্রচারকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কেন্দ্রের আতশকাচের তলায় থাকছে এর বিজ্ঞাপনী প্রচারও। যাঁরা এই ধরনের প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপন দেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে প্রস্তাব রাখা হয়েছে এই বিলে। বহু খ্যাতনামীই অনলাইনে গেম খেলার জন্য উৎসাহ দিয়ে বিজ্ঞাপন করে থাকেন।
ভবিষ্যতে এই ধরনের বিজ্ঞাপনে দু’বছর পর্যন্ত জেল ও ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
বিশেষজ্ঞ এবং বণিকমহলের একাংশ মনে করছেন, অনলাইন গেমিংয়ের উপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা জারি না করে বিকল্প ব্যবস্থাগুলি ভেবে দেখা যেতে পারে। শীর্ষে থাকা চারটি অনলাইন গেমিং ফার্মের মধ্যে একটির এক জন আধিকারিক সংবাদমাধ্যমে বলেছেন যে, কোম্পানির কর্মীরা ইতিমধ্যেই বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে শুরু করে দিয়েছেন।
গেমিং শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের মতে বিলটি শিল্পকে অন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি, লক্ষ লক্ষ কর্মীর কর্মসংস্থান হারানোর ব্যাপারে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার কোনও সুযোগই রাখা হয়নি।