কথায় আছে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। বাংলার এই প্রবাদবাক্যকে নিজের জীবনের আপ্তবাক্য করে নিয়েছেন জাপানের বাসিন্দা। প্রচুর সম্পত্তি ও বার্ষিক মোটা টাকা আয়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখনও খেটে অর্থ উপার্জন করেন এক প্রৌঢ়। নির্দিষ্ট দিনগুলিতে রুটিন মেনে কর্মস্থলে গিয়ে হাজিরা দিতে দেখা যায় তাঁকে।
কোটি কোটি টাকার মালিক টোকিয়োর বাসিন্দা কোইচি মাতসুবারা। ইচ্ছা করলেই বিলাসবহুল জীবনে গা ভাসিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। সেই সামর্থ্যও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে এখনও এক জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন ৫৬ বছরের এই জাপানি।
‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের’ একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাড়িভাড়া এবং বিনিয়োগ থেকে বার্ষিক ২ কোটি ইয়েন (১.৭৩ কোটি টাকা)আয় করেন তিনি। বিপুল আয় করা সত্ত্বেও কোইচি স্বেচ্ছায় পরিচারকের পেশা বেছে নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সপ্তাহে তিন দিন, কোইচিকে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানে ঝাড়ু দিতে দেখা যায়। কখনও কখনও আলোর বাল্ব মেরামত করতে দেখা যায়। এ ছাড়াও টুকিটাকি প্রয়োজনীয় কাজেও আপত্তি নেই কোইচির। সপ্তাহে তিন দিন চার ঘণ্টা শিফটে কাজ করেন। এর ফলে তাঁর মাসিক রোজগার ১০০,০০০ ইয়েন বা ৫৪,০০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে এর থেকে বেশি টাকা তাঁর জমানো পুঁজি থেকেই আয় হয়।
টোকিয়োর গড় মাসিক বেতন ৩ লক্ষ ৫০,০০০ ইয়েন (২ লক্ষ১১ হাজার ২৪০ টাকা)। সেই তুলনায় কোইচির অনেক কম করলেও তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চান কোইচি। শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে সক্রিয় এবং সুস্থ থাকতে পছন্দ করেন কোইচি।
সংবাদমাধ্যমে কোইচি জানিয়েছেন, ঘুম থেকে উঠে কর্মক্ষেত্রে যাওয়াটা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত এলাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে তাঁর ভাল লাগে। এই কাজটি করার জন্য উৎসাহ বোধ করেন কোইচি। সেই ভাল লাগার জন্য উপায় থাকা সত্ত্বেও কাজ থেকে অবসর নেওয়ার চিন্তা মাথায় আনেননি তিনি।
ছোটবেলায় বাবা-মায়ের মধ্যে এক জনকে হারিয়েছিলেন কোইচি। একক অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠা তাঁর। অল্প বয়সেই টাকার মূল্য বুঝতে শিখে গিয়েছিলেন কোইচি। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর তিনি একটি কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। সেখানে তাঁর প্রতি মাসের বেতন ছিল ১ লক্ষ ৮০ হাজার ইয়েন (৯৭ হাজার টাকা)। রোজগার শুরু করার পর থেকেই তিনি যত্ন সহকারে প্রতিটি পাই-পয়সা সঞ্চয় করতেন।
এই ভাবে কয়েক বছরের মধ্যে ৩০ লক্ষ ইয়েন জমিয়ে ফেলেন। ভারতীয় মুদ্রায় ১৬ লক্ষ টাকা। সেই টাকা দিয়ে একটি স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেলেন কোইচি। প্রথম একটি সম্পত্তির মালিকানা আসে তাঁর কাছে। যে সময় তিনি অ্যাপার্টমেন্টটি কিনেছিলেন সেই সময় আবাসন ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দিয়েছিল।
সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন কোইচি। যে টাকা জমিয়েছিলেন তার সঙ্গে ঋণ নিয়ে একের পর এক সম্পত্তি কিনে নিতে শুরু করেন। সেই প্রবণতার ফলে কোইচি আজ টোকিয়ো ও শহরতলিতে ৭টি সম্পত্তির মালিক। প্রতিটি বাড়িতে ভাড়া বসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে দ্রুত ঋণও শোধ করতে সমর্থ হন এই জাপানি প্রৌঢ়।
সম্পত্তি থেকে যে আয় হত সেগুলি তিনি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। সুকৌশলে স্টকের বিনিয়োগ করার ফলে তাঁর পুঁজি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।
কোটিপতি হওয়া সত্ত্বেও, কোইচি সাদামাঠা ও সাধারণ জীবনযাপন করেন। তিনি একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন। সাধারণ খাবার রান্না করে খান। আশ্চর্যের বিষয় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নতুন পোশাক কেনেননি। গাড়ির পরিবর্তে সাইকেল চালান। অতি সাধারণ একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
প্রচুর সম্পদের মালিক কোইচি মিতব্যয়ী, সরল জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। তাঁর বক্তব্য, একজন পরিচারক হিসাবে কাজ করা অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়। এটি শরীরকে সক্রিয় রাখার উপায়।
তিনি যে ভবনে কাজ করেন সেই ভবনের সবচেয়ে ধনী বাসিন্দাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। যদিও তাঁর চলনে-বলনে সেই আঁচটুকু পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি এই ধরনের মনোযোগ আকর্ষণ করার ঘোর বিপক্ষে। তাঁর দর্শনটি সহজ। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি আমার সম্পদ প্রদর্শন করতে চাই না। আমি কেবল ভাল ভাবে বাঁচতে চাই। সুস্থ থাকতে চাই। নিজের জন্য চিন্তা করতে চাই।’’
কোইচির মতে, টাকার চেয়েও বেশি মূল্যবান স্বাস্থ্য। প্রতি দিন কর্মক্ষম থাকার ক্ষমতাকে অর্থ বা সম্পদের থেকে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তিনি। তাই তিনি অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতাও এড়িয়ে চলেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কোইচিকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করেছে।
প্রায় ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। আর কয়েক বছর কাজ করার পর ৬০ বছর বয়সে পেনশনের জন্য অপেক্ষা করছেন কোটিপতি পরিচারক কোইচি।
জাপানে অবশ্য মিতব্যয়িতা নতুন কিছু নয়। ৭৫ বছর বয়সি এক ব্যক্তি দশ বছরের বেশি সময় ধরে টাকার পরিবর্তে কুপন এবং বিনামূল্যের অফার ব্যবহার করে জীবন ধারণ করে আসছেন। তিনি ১,০০০টিরও বেশি সংস্থার শেয়ারের মালিক। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি ইয়েনের বেশি। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকারও বেশি।