পাকিস্তানের প্রথম ডেটিং রিয়্যালিটি শো। তা-ও আবার বিদেশি শোয়ের আদলে তৈরি। সেই অনুষ্ঠানটির প্রোমো সম্প্রচারিত হতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে পাকিস্তান জুড়ে। ২৯ সেপ্টেম্বর সম্প্রচারের আগেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ‘লাজ়াওয়াল ইশক’ নামের এই রিয়্যালিটি শো। ১০০ পর্বের রিয়্যালিটি শোয়ে মোট আট জন প্রতিযোগীকে যোগ দিতে দেখা যাবে।
চার জোড়া পাকিস্তানি পুরুষ ও নারীকে একটি ভিলায় রেখে তাঁদের ২৪ ঘণ্টা ধরে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হবে। এখানে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের সঙ্গে প্রেম ও সম্পর্ক তৈরি করার মতো ‘টাস্ক’-এর মুখোমুখি হবেন। পুরুষ ও মহিলা প্রতিযোগীরা তুরস্কের একটি দ্বীপের বিলাসবহুল প্রাসাদে একসঙ্গে থাকবেন।
সেই আট জন সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রতিযোগীকে একই ছাদের নীচে বসবাস করে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। প্রেম, সম্পর্ক থেকে শুরু করে তাঁদের ২৪ ঘণ্টার জীবনযাপনের খুঁটিনাটি— সব কিছুই ক্যামেরাবন্দি করা হবে। আর এখানেই রে-রে করে উঠেছে পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ।
শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের প্রথম ঝলক সমাজমাধ্যম প্রকাশ্যে আসতেই গোটা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এই অনুষ্ঠানটি কোনও টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত হবে না। ‘লাজ়াওয়াল ইশক’ প্রচার করার জন্য স্বতন্ত্র একটি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। সিরিজ়টি কেবল ইউটিউবেই দেখা যাবে এবং এর কোনও পর্বই এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
‘লাজ়াওয়াল ইশক’— বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় চিরন্তন ভালবাসা। সেই রিয়্যালিটি শো উপস্থাপনা করেছেন খ্যাতনামী পাকিস্তানি অভিনেত্রী আয়েশা ওমর। অনুষ্ঠানের পুরোটাই তৈরি হয়েছে তুরস্কের ইস্তানবুলে। এমনকি, এই শো তুরস্কে প্রচারিত ‘আস্ক আদাসিকে’ নামের একটি রিয়্যালিটি শোয়ের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। আর এই সমস্ত ডেটিং রিয়্যালিটি শোগুলির ধারণা যে মূল শো থেকে এসেছে সেটি হল ‘লভ আইল্যান্ড’। আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই ডেটিং শো।
‘লভ আইল্যান্ডের’ মতো ডেটিং শোগুলির নিয়ম হল প্রতিযোগীরা পছন্দমতো নিজেদের মধ্যে জুটি বাঁধবেন। প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করবেন। এমনকি সঙ্গীর অনুমতিসাপেক্ষে সঙ্গম বা যৌনতায় লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু বর্ণগত নিন্দা, সমকামিতা, আক্রমণাত্মক ভাষা, যৌন হয়রানি, অথবা হিংস্র আচরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে বার করে দেওয়া হয় প্রতিযোগীদের।
ভিলায় যে হেতু শোয়ের অন্য প্রতিযোগী বা অনুষ্ঠান পরিচালনার কর্মচারীরা থাকেন তাই এখানে কোনও প্রকার নগ্নতার স্থান নেই। অনুমতিসাপেক্ষে মদ্যপানের সুযোগ আছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ফোন তো দূর অস্ত, ব্যক্তিগত কোনও বই বা ম্যাগাজ়িনও রাখার অনুমতি থাকে না সেখানে।
‘লভ আইল্যান্ড’-এর পাক সংস্করণের যে প্রথম ঝলক সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে দেখা গিয়েছে, প্রতিযোগীদের ভিলায় স্বাগত জানানো হচ্ছে। সঞ্চালিকা আয়েশা বিলাসবহুল প্রাসাদের মূল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ট্রেলারের ভিডিয়োটি।
একটি জমকালো লাল গাউন পরে, দর্শককে একটি বিলাসবহুল ভিলায় স্বাগত জানাচ্ছেন আয়েশা। অনুষ্ঠানটি ইস্তানবুলের বসফোরাসের কেন্দ্রস্থলে একটি বিলাসবহুল প্রাসাদোপম ভিলায় আয়োজন করা হয়েছে। ট্রেলারের ভিডিয়োয় প্রতিযোগীদেরও এক ঝলক দেখতে পাওয়া গিয়েছে। বেশির ভাগই অপরিচিত মুখ।
নিন্দকেরা এই ধরনের অনুষ্ঠানকে ইসলামের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলির সংস্কৃতি অনুকরণ করে তৈরি শোয়ের সম্প্রচার বন্ধের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন অনেকেই। উর্দু ভাষার অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে পাক জনগণের একাংশের অভিযোগের বন্যা বয়ে গিয়েছে সমাজমাধ্যম জুড়ে।
পাকিস্তানে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক অবৈধ। ডেটিং ঘিরেও নানা ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে সে দেশের রক্ষণশীল নাগরিকদের মধ্যে। এক কথায় ডেটিংকে অপসংস্কৃতি বলে মনে করেন গোঁড়া পাকিস্তানিরা। সেই মনোভাবেরই ঝলক উঠে এসেছে সমাজমাধ্যমে। এক জন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “ইরান, কোরিয়া, তুরস্ক, আরবেরা এটা করেছে। তারা সবাই এই নকল প্রেমের সার্কাসের প্রতিটি অংশকে নিংড়ে নিয়েছে। আর এখন, পাকিস্তান গর্বের সঙ্গে একই ক্লান্তিকর স্ক্রিপ্টের জন্য লাইনে দাঁড়াতে চায়। নাম দিয়েছে লাজ়াওয়াল ইশ্ক।’’
অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের আগেই সেটিকে বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান ইলেকট্রনিক মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটির কাছে বহু নেটাগরিক আবেদন করেছেন। সংস্থার মুখপাত্র মুহাম্মদ তাহির সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানটি মূলধারার মাধ্যম বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনও টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হচ্ছে না।
তাহির অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, ‘‘আমরা ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করি না। এই বিষয়বস্তু কোনও টেলিভিশন চ্যানেলের নয়। সাধারণ মানুষ জানেন না যে ইউটিউব আমাদের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে পড়ে না।’’ তাই এ ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারে কোনও বাধা বা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে অক্ষম পাক সরকার।
বিতর্কিত শোয়ের সঞ্চালিকা আয়েশা জানিয়েছেন, ১০০টি পর্বের অনুষ্ঠানে আট জন প্রতিযোগী নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে প্রতিযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যত ক্ষণ না কোনও দম্পতি বিজয়ী হিসাবে মনোনীত হচ্ছেন এই প্রতিযোগিতা চলবে।
আয়েশার মতে, অনুষ্ঠানের এক ঝলক দেখে সবাই বিভিন্ন ধরনের জল্পনা-কল্পনা করছেন। কিছু লোক ভুল ভাবে উপস্থাপন করছেন এটিকে। এটি শুধুমাত্র পাকিস্তানি ছেলে-মেয়েদের একটি ভিলায় একত্রবাসের গল্প নয়। তিনি জানান, এই শো যত ক্ষণ না সম্প্রচারিত হচ্ছে তত ক্ষণ এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিশদে জানা যাবে না।
আয়েশার দাবি, অনুষ্ঠানটি পাক সংস্কৃতি, নীতি এবং মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খাইয়েই তৈরি করা হচ্ছে। সমাজ যেমন চিরন্তন প্রেম, বিবাহ ও পবিত্র মিলনের দিকে পরিচালিত করে তেমন ভাবেই অনুষ্ঠানটি শেষ করা হবে বলে জানান অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা। মাত্র ১০ দিন আগে ইস্তানবুলে শুটিং শুরু হয়েছে। শুটিংয়ের আরও এক মাস বাকি রয়েছে।