গত বছরের ৫ অগস্ট বাংলাদেশে হাসিনার সরকারের পতন হয়। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তার পর কেটে গিয়েছে ছ’মাস। সেই সময়ের মতো বাংলাদেশে শেখ হাসিনা-বিরোধীদের ক্ষোভ ফের গিয়ে পড়ল ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাড়িটি দৃশ্যত পরিত্যক্ত ছিল। এই বাড়িতেই পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশে রক্তাক্ত পালাবদলের সময় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ। মুজিব-কন্যা হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির সেই বাড়িটিকে পরিণত করেছিলেন সংগ্রহশালায়।
বুধবার বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের ছ’মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সে দিন বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভার্চুয়াল ভাষণ দেন হাসিনা। তবে ভার্চুয়াল ভাষণ শুরুর আগেই ফের জনরোষের মুখে পড়ে মুজিবুরের স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি। সেই ধ্বংসযজ্ঞের ছবি প্রকাশ্যে এসেছে।
হাসিনার ভার্চুয়াল বক্তৃতার কথা সমাজমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পরেই বুধবার বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি।
সন্ধ্যা ৭টার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘‘আজ (বুধবার) রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।” সমাজমাধ্যমে ডাক দেওয়া হয়, ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ কর্মসূচির। রাত গড়াতেই বুলডোজ়ার এনে শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপুরুষের স্মৃতি ধ্বংসের কাজ।
এর পর মুজিবের বাড়িতে তাণ্ডব, ভাঙচুর চালায় জনতা। পরে সেখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর পর বেশি রাতের দিকে বুলডোজ়ার, ক্রেন, ভ্যাকুয়ম মেশিন নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় মুজিবের স্মৃতি জড়ানো ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি ভাঙার কাজ।
বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার রাত প্রায় ১১টা নাগাদ ধানমন্ডিতে মুজিবের বাড়ির সামনে একটি ক্রেন এবং একটি এক্সকাভেটর এনে বাড়ি ভাঙা শুরু হয়। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ভবনের একটি অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতভর ‘অভিযানে’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বাড়ির বেশির ভাগ অংশই। বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির বাকি অংশ ভেঙে ফেলার কাজও শুরু হয়।
খবর, বহু সাধারণ মানুষ সেই বাড়ি এবং মুজিবের স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর থেকে বইপত্র, ইট-কাঠ-পাথর তুলে নিয়ে যান। সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু ছবি প্রকাশ্যে এসেছে ইতিমধ্যেই। যদিও বাংলাদেশের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলারক্ষী বাহিনীর কাউকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। ‘প্রথম আলো’র তরফে বৃহস্পতিবার সকালে দমকল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। দমকলের ঢাকা কন্ট্রোল রুমের মবিলাইজ়িং অফিসার খালেদা ইয়াসমিন বলেন, ‘‘সুধা সদনে আগুন লাগার খবর আমরা পাই রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা ছিল না। ওখানে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাই আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি।’’
বুলডোজ়ার, ক্রেন এনে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি গুঁড়িয়ে দিয়েও রোষ মেটেনি বাংলাদেশের বিক্ষোভকারীদের। বুধবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে গিয়েছে উন্মত্ত জনতার হামলা। নিশানায় ছিলেন হাসিনা-সহ আওয়ামী লীগের নেতারা। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি চলে দেদার লুটপাটও!
ধানমন্ডির ৫/এ-তে হাসিনার বাড়ি সুধা সদনেও আগুন ধরানো হয় বুধবার রাতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা ‘প্রথম আলো’কে জানান, রাতে সাড়ে ১০টার পরে ধানমন্ডিতে হাসিনার বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেন কয়েক জন। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত আগুন জ্বললেও হামলার আশঙ্কায় তা নেভাতে যাননি দমকলকর্মীরা!
রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার রাতে বঙ্গবন্ধু মুজিব এবং হাসিনার ম্যুরাল ভেঙে দেন একদল বিক্ষোভকারী। সেখানকার আল বেরুনী হলের দেওয়ালে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গ্রাফিতিও রং দিয়ে মুছে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
রাত থেকেই ঢাকার বাইরেও ক্রমশ ছড়াতে শুরু করে হাসিনা-বিরোধী রোষ। খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে ‘শেখ বাড়ি’। সেটি ছিল হাসিনার কাকার বাড়ি। বুধবার রাতে সিটি করপোরেশনের দু’টি বুলডোজ়ার নিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়। কুষ্টিয়ায় বুলডোজ়ার চলেছে প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িতে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হামলাকারীদের দাবি, আওয়ামী লীগকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি আবাসিক হল ও একটি স্কুলের নামফলক ভেঙে নতুন নামকরণ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয়-২৪ হল’, নির্মাণাধীন শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের পরিবর্তে ‘শহিদ আলি রায়হান হল’, শেখ হাসিনা হলের পরিবর্তে ‘ফাতিমা আল-ফাহরিয়া হল’ এবং শেখ ফজিলাতুন্নেসা হলের পরিবর্তে ‘নবাব ফয়জুন নেসা চৌধুরানী’ নাম দিয়ে ব্যানার ঝুলিয়ে দেন তাঁরা। এ ছাড়া শেখ রাসেল মডেল স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ‘রিয়া গোপ মডেল স্কুল’ করা হয়।
বুধবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ভোলা সদরের গাজীপুর সড়কে ‘প্রিয় কুটির’ নামে একটি বাড়িতে আগুন ধরানো হয়। সেটি আওয়ামী লীগ নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বাড়ি। ৫ অগস্টে পালাবদলের পরে অবশ্য আর ভোলার ওই বাড়িতে যাননি তোফায়েল। রাত ১টা নাগাদ কুমিল্লার মুন্সেফবাড়ি এলাকায় প্রাক্তন সাংসদ বাহাউদ্দীন বাহারের বাড়িতেও ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে অভিযোগ। পিরোজপুরে জাতীয় সংসদের প্রাক্তন সদস্য একেএমএ আউয়াল এবং তাঁর ভাই তথা মেয়র হাবিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা।