পোষা মুরগিকে উদরস্থ করতে নিঃশব্দে হাজির হয়েছিল বিষাক্ত সাপটি। দেখতে পেয়ে সাপটির মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেন ৪৫ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। সাপের দেহটি ফেলে দেওয়ার জন্য ধরতেই সেই কাটা মাথাটি তাঁর বুড়ো আঙুলে মোক্ষম কামড় দেয়। মরা সাপের কামড়ে যে শরীরে বিষ ঢুকতে পারে সে কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি তিনি।
কামড়ের পর তীব্র ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে ছোটা হয় তাঁকে। বার বার বমি, তীব্র মাথা ব্যথা, ক্ষতস্থান কালো হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ পরীক্ষা করে শিরায় অ্যান্টিভেনম এবং ব্যথা উপশমের ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। প্রায় ২০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা চলে মরা সাপে কাটা রোগীর। কোনও রকমে প্রাণে বাঁচেন তিনি। চিকিৎসার পর তাঁর স্নায়বিক বৈকল্যের লক্ষণ দেখা যায়নি।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল ধানের খেতে। চাষের কাজ করার সময় ট্রাক্টর দিয়ে একটি কেউটেকে পিষে দেন। কেউটেটি মারা যাওয়ার পর সেটির উপর অসাবধানে পা দিয়ে দেন কৃষক। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পায়ে কামড় বসিয়ে দেয় মরা সরীসৃপটি। কামড়ের স্থানে তীব্র ব্যথা, ফোলা ও অসাড় ভাব লক্ষ করেন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় বমি। যদিও নিউরোটক্সিসিটির বা স্নায়ুঘটিত কোনও বিকারের লক্ষণ ছিল না।
সাপের কামড়ে ক্ষতস্থান বিষিয়ে গিয়েছিল ওই চাষির। মৃত সাপের একটি ছবিও তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সেই ছবি দেখে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন যে কেউটের ছোবলেই এই দশা হয়েছে তাঁর। অ্যান্টিভেনম চিকিৎসার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়।
তৃতীয় ঘটনাটিও অনুরূপ। একটি কালো সাপ এক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং তাকে মেরে ফেলা হয়। দেহটি বাড়ির উঠোনে ফেলে দেওয়া হয়। পরে এক প্রতিবেশী এসে সাপের মাথাটি তুলে নিয়েছিলেন। তার আঙুলেও সাপের দাঁত বসে যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ব্যক্তির ঢোঁক গিলতে অসুবিধা হয় এবং চোখের পাতা ঝুলে পড়ে।
মৃত সাপটিকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোতেই চিকিৎসকেরা সেটিকে কালো ক্রেট বলে শনাক্ত করেন। তাঁরা নিশ্চিত করেছিলেন যে সাপটি ৩ ঘণ্টা আগেই মারা গিয়েছে। তার পরেও কামড় বসাতে সমর্থ হয়েছে। রোগীকে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনমের ২০টি ভায়াল দেওয়ার পরও তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। তিনি কোয়াড্রিপ্লেজিয়ায় আক্রান্ত হন।
এই রোগে হাত-পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আক্রান্ত নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মস্তিষ্ক থেকে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সঙ্কেত এসে পৌঁছোতে বাধা পায়। ৪৩ ঘণ্টা যন্ত্রের সহায়তার পর রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়। ছ’দিন হাসপাতালে থাকার পর সাপে কাটা রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তিনটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে একটাই যোগসূত্র। সাপে কামড়ানো তিন জনই ‘মৃত’ সাপের কামড় খেয়েছিলেন। এই ঘটনাগুলির উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা চালানো হয়। সেই গবেষণায় উঠে এসেছে কেউটে এবং ক্রেট-সহ কিছু মারাত্মক বিষধর সাপের প্রজাতি মৃত্যুর পরেও বিষ ঢালতে সক্ষম।
মোনোক্লেড কোবরা, সাদা বাংলায় আমরা যাকে কেউটে বলে থাকি, ফণার একটি গোলাকার চিহ্ন দ্বারা এদের চেনা যায়। এদের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়। সাধারণত নিম্নভূমি, জলাভূমি এবং ধানখেতে এদের দেখা মেলে। বাংলায় ক্রেট গোত্রীয় যে যে সাপের দেখা মেলে তা হল কালাচ বা কমন ক্রেট, ব্যান্ডেড ক্রেট বা শাঁখামুটি।
আগে ধারণা ছিল মৃত্যুর পরেও বিষ ঢালার ক্ষমতা কেবল র্যাট্লস্নেক এবং আফ্রিকার স্পিটিং কোবরা জাতীয় নির্দিষ্ট কয়েকটি সাপের প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি অসমের গবেষকেরা দেখেছেন যে ভারতীয় কেউটে, শাঁখামুটি বা কালাচও তাদের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরে বিষ প্রয়োগ করতে পারে।
গবেষণাপত্রটি ফ্রন্টিয়ার্স ইন ট্রপিক্যাল ডিজ়িজ় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সেই গবেষণাপত্রে গবেষকেরা ব্যাখ্যা করেছেন যে কিছু সাপের বিষ সরবরাহের একটি অনন্য পদ্ধতি থাকে যা মৃত্যুর পরেও বিষ নির্গত করতে সাহায্য করে। মৃত্যুর পরেও বিষগ্রন্থিগুলি বেশ কিছু ক্ষণের জন্য কার্যকর থাকে। তাই সাপের বিচ্ছিন্ন মাথাও সম্ভাব্য বিপজ্জনক কামড়ের কারণ হতে পারে।
সাপের দাঁতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে বিষগ্রন্থি। বিষগ্রন্থিতে নিঃসৃত বিষ সংরক্ষণের জন্য একটি বৃহৎ ফাঁপা নলের মতো অংশ থাকে। কামড় বা ছোবলের ফলে চাপ পড়লে ফাঁপা দাঁতের মাধ্যমে সেই গ্রন্থি থেকে বিষ বেরিয়ে আসে।
তাই সাপ মারা যাওয়ার সময় কাটা মাথাটি স্পর্শ করলে বা দুর্ঘটনাক্রমে চাপ দিলে বিষ বেরিয়ে আসে। এর ফলে জীবন্ত সাপের কামড়ের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
সরীসৃপবিদ অনির্বাণ চৌধুরী আনন্দবাজার ডট কমকে জানিয়েছেন, মানুষের মতো সাপের শরীরেও অনৈচ্ছিক পেশি রয়েছে। এই পেশিগুলি স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। যেমন আভ্যন্তরীণ অঙ্গ ও রক্তনালির পেশিগুলি। মারা যাওয়ার পর মস্তিষ্ক অকেজো হলেও এই পেশিগুলি সক্রিয় থাকে। ঠিক যেমন টিকটিকির লেজ কাটার পরও তা নড়াচড়া করতে পারে।
মৃত সাপের বিষগ্রন্থিটি যদি অসাবধানতাবশত নাড়াচাড়া করার সময় চাপ দেওয়া হয়, তা হলে পেশির চাপে বিষটি দাঁতের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে। জীবিত সাপের কামড়ের মতোই তীব্র উপসর্গ তৈরি করে। মারাত্মক আঘাতের পরেও দাঁতের মধ্যে সক্রিয় বিষ ধরা থাকে, যা বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম।